স্টাফ রিপোর্টার :
ঝালকাঠির নলছিটিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে ‘ক্লাস প্রেমিক’ কে এম রাইদ ইসলাম রামিমকে। বুধবার দুপুরে নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশ্রাফুল ইসলাম তাকে সংবর্ধনা দেন। শিক্ষা জীবনে রামিম টানা ১৪ বছরে কোন ক্লাস কামাই দেয়নি। প্লে থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এক দিনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতি নেই তাঁর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পারিবারিক সমস্যা, এমনকি রোগব্যাধি উপেক্ষা করেও নিয়মিত ক্লাসে হাজির। পড়ালেখার প্রতি ভালোবাসা, প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি ও পরিবারের উৎসাহে এক দিনও ক্লাস কামাই না করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে রামিম। সে ঢাকার রাজুক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। রামিম ঝালকাঠির নলছিটি শহরের ব্যবসায়ী কে এম মোস্তাক খানের ছেলে। তাঁর মা গৃহিণী নাজমা আক্তার। ক্লাসে শতভাগ উপস্থিতির কারণে বিদ্যালয় থেকে সে একাধিক পুরস্কার ও সনদপত্র পেয়েছে। তাকে শিক্ষার্থীদের ‘অনুকরণীয় আদর্শ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তাঁর শিক্ষকরা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে রামিমকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা মা ছাড়াও নলছিটি পৌর মেয়র তছলিম উদ্দিন চৌধুরীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রামিম জানায়, সে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একজন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার প্রবল আগ্রহ তাঁর। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত পেতে সকলের সহযোগিতা চেয়েছে রামিম।
জানা গেছে, রামিমের জন্ম ২০০১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নলছিটি পৌর কিন্ডার গার্টেনে প্লে ক্লাসে ভর্তি করা হয় তাকে। প্লে ক্লাসে এক বছরে টানা উপস্থিতি ছিল তাঁর। পরে নার্সারি ক্লাসেও শতভাগ উপস্থিতি। দুই বছরের টানা উপস্থিতির কারণে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে দুটি পুরস্কার দেয়। এতে শ্রেণিকক্ষের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। ২০১১ সালে ওই কিন্ডার গার্টেন থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং ওই প্রতিষ্ঠান থেকে একমাত্র ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে। সেই কিন্ডার গার্টেনে শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির জন্য সাত বছরে সাতটি পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে। এক নাগারে সাত বছর টানা শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতি ও ২০১১ সালে ওই কিন্ডার গার্টেন থেকে একাই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করায় তত্কালীন অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট আনিচুর রহমান খান হেলাল তাকে বিশেষ পুরস্কার (ক্রেস্ট) ও সনদপত্র প্রদান করেন।
২০১২ সালে রামিম নলছিটি মার্চেন্টস মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শেণিতে ভর্তি হয়। সেখানেও নিয়মিত ক্লাস শুরু করে। এরই মধ্যে তাঁর বাবা ও মা ভারত যেতে তাঁর জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা সংগ্রহ করেন। কিন্তু বেঁকে বসে সে। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকার কারণে তার ভারত ভ্রমণে যাওয়া হয়নি। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতির পাশাপাশি ২০১৪ সালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায় সে। গত ১২ বছরের মধ্যে তাঁর নানা, মামা ও চাচার মৃত্যু হয়েছে, তবু তাঁর ক্লাস কামাই হয়নি। ঢাকার রাজুক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার আগে জীবনের শেষ ক্লাসে অংশ নিয়ে সে টানা ১৪ বছর শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির রেকর্ড গড়ে। প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১ থেকে ৩ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে তাঁর রোল নম্বর।
রামিম বলে, ‘আমি যখন বুঝতে পারলাম শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতিই ভালো ফলাফলের একমাত্র মাধ্যম, তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি, যত দিন পড়ালেখা করব এক দিনও ক্লাস বন্ধ দেব না। ক্লাসে ঠিকমতো পড়ালেখা করলে প্রাইভেট পড়তেও হয় না। প্রতিদিন ক্লাসে আসার কারণে শিক্ষকরাও আমাকে ভালোবাসেন। আমাকে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অনেক সহপাঠীকে বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসার জন্য বলেন। আমি ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে চাই। আমি যত দিন শিক্ষার্থী থকব, তত দিনই সব ক্লাসে উপস্থিত থাকব।’ এখন আমার একটাই ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার।
রামিমের বাবা কে এম মোস্তাক খান বলেন, ‘রোগব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সিডর, আয়লা মহাসেন, ফণিসহ প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও রামিম নিয়মিত নিজ উদ্যোগে আমাদের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতো। এ জন্য দীর্ঘ এক যুগ শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির রেকর্ড গড়তে পেরেছে। তাঁর এ বিরল কৃতিত্বের বিষয়টি দেশের সব শিক্ষার্থীকে জানিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।’
রামিমের মা নাজমা আক্তার বলেন, ‘সারাক্ষণ পড়ালেখার মাঝেই ডুবে থাকতে পছন্দ করে রামিম। স্কুল ছুটি হলে বিদ্যালয়ে পাঠদান, শিক্ষক ও সহপাঠীদের নিয়ে আমার কাছে গল্প করত। একদিন ক্লাস বন্ধ দেওয়া মানে তাঁর কাছে সব কিছু হারানোর মতো একটি বিষয় ছিল। তাই আমরাও তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো জোর খাটাইনি।’
নলছিটি পৌর কিন্ডার গার্টেনের সাবেক অধ্যক্ষ আনিচুর রহসান খান হেলাল বলেন, ‘রামিম একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। টানা ১৪ বছর সে কখনো ক্লাসে অনুপস্থিত হয়নি। একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই ছেলে যেকোনো কর্মস্থলে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সফলতা আনতে পারবে। তাঁর এ কৃতিত্বের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সম্মাননা এবং পুরস্কৃত করা উচিত। তাহলে অন্য শিক্ষার্থীদেরও ক্লাসে উপস্থিতির প্রতি আগ্রহ বাড়বে।’
নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশ্রাফুল ইসলাম বলেন, রামিমের কৃতিত্ব ও বিরল ক্লাস প্রেমের কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। একটি ছেলের কটটা ধৈর্য্য থাকলে সে টানা ১৪ বছর ক্লাসে একটিও কামাই দেয়নি। আমি তাঁর গল্প শুনে একটি সংবর্ধনা দিয়েছি। আশাকরি তাঁর সকল ইচ্ছা পূরণ হবে। সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে, এ আশাটাও তাঁর পূরণ হবে।