ডেস্ক রিপোর্ট : থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো (৩, ২, ১, ০)। যাত্রা শুরু করল দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান লেখা স্যাটেলাইটটি মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে গত রাতে স্যাটেলাইট অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা ১৪ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিট) ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে স্যাটেলাইটটির সফল উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়। যোগাযোগ ও সম্প্রচারের এই স্যাটেলাইটটি নিয়ে মহাকাশে রওনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কম্পানি স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেট। উৎক্ষেপণের আনুমানিক ৩৩ মিনিট পর স্যাটেলাইটটি বহনকারী রকেট কক্ষপথে প্রবেশ করে।
স্যাটেলাইটটির বিস্তৃতি হবে বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত। পদ্মা সেতুর পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দেশবাসীর জন্য দ্বিতীয় গর্বের বিষয়।
স্যাটেলাইটটির উেপক্ষপণ দৃশ্য স্পেসএক্স সরাসরি তাদের ওয়েবসাইটে সম্প্রচার করে। রাত জেগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বড় পর্দার মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক ক্ষণের সাক্ষী হয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ জেলা প্রশাসনগুলোর আয়োজনে এই উৎক্ষেপণ দৃশ্য দেখানো হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বহু বাংলাদেশিও এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সরাসরি সম্প্রচার প্রত্যক্ষ করে।
‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিভিশন ভাষণে এর শুভ উৎক্ষেপণ ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ফ্লোরিডায় এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রত্যক্ষ করে। ফ্লোরিডার স্বচ্ছ আকাশে প্রায় ৭ মিনিট স্যাটেলাইটটি দেখা যায়।
ফ্লোরিডা থেকে উৎক্ষেপণ প্রত্যক্ষকারী আইসিটি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, ‘আমি আজকের দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করতে চাই, যিনি ১৯৭৪ সালে দেশের সর্বপ্রথম স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে মহাকাশ যুগে প্রবেশের কার্যক্রমের সূচনা করেন। ’ তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রযুক্তিকেন্দ্রিক উত্তরণের দৃষ্টান্ত।
প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু-১ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সময়োপযোগী উদ্যোগও, যার ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিশন রয়েছে। ’
এর আগে তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছিলেন, বহনকারী রকেট বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটকে মহাকাশে বাংলাদেশের ভাড়া নেওয়া অরবিটাল স্লট ১১৯.৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে যাবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফ্রান্সের থ্যালেস এলেনিয়া স্পেসের তৈরি স্যাটেলাইটটির ওজন জ্বালানিসহ তিন হাজার ৭০০ কেজি। স্যাটেলাইটটির জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপরে। এয়ার ট্রাফিকের কারণে কক্ষপথের ওই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে আট থেকে ১২ দিন সময় লাগবে। এরপর স্যাটেলাইটটি বাংলাদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত দুটি গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযাগ করতে সক্ষম হবে। বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে আরো তিন মাস সময় লাগতে পারে।
স্যাটেলাইটটি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কম্পানি লিমিটেড নামে একটি কম্পানি গঠন করা হয়েছে। কম্পানির বর্তমান জনবল ১৮ জন প্রকৌশলীসহ ৩৫ জনের মতো। ভূমি থেকে উপগ্রহটি নিয়ন্ত্রণের জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুর এবং রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নিজস্ব জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি ‘গ্রাউন্ড স্টেশন’।
বঙ্গবন্ধু-১ একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট। এর জন্য ব্যয় হচ্ছে দুই হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্যাটেলাইটটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মেয়াদ ১৫ বছর।
এই স্যাটেলাইট থেকে দেশ কী ধরনের সেবা পাবে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এতে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ১৪টি সি এবং ২৬টি কেইউ ব্যান্ডের। ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে এবং বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া হবে। এই স্যাটেলাইটে বিদেশনির্ভরতা কমবে। বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রতিবছর এক কোটি ৪০ লাখ ডলার খরচ হয়। নিজস্ব স্যাটেলাইট হলে এ টাকা দেশেই থাকবে।
এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রচারভিত্তিক সেবা প্রসার সহজতর হবে। বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে অবসান হবে পরনির্ভরশীলতার। ডিটিএইচ, ভিডিও ট্রান্সমিশন, ভি-স্যাট, প্রাইভেট নেটওয়ার্ক, পয়েন্ট টু পয়েন্ট কানেকশন—এসব সেবা সহজ হবে। প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতেও ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্বের অভিজাত দেশগুলোয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তিনটি ক্যাটাগরিতে সেবা দেবে। ব্রডকাস্টিং, টেলিকমিউনিকেশন ও ডাটা কমিউনিকেশন সেবা দিয়ে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে অভূতপূর্ব উন্নতি করবে। ’
এর আগে ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৭ মিনিট) স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের আয়োজন করা হয়েছিল। স্যাটেলাইটটি রকেটে স্থাপন ও জ্বালানি ভরাসহ সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। উৎক্ষেপণের ওই নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগে ধোঁয়াও ছাড়তে শুরু করেছিল ফ্যালকন-৯। কিন্তু শেষ মিনিটে এসে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়।
গত বৃহস্পতিবারই স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ১২ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ২২ মিনিটের (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিট) মধ্যে যেকোনো সময় স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করার কথা ছিল। একপর্যায়ে স্পেসএক্স স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৪২ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৪২ মিনিট) উৎক্ষেপণ সময় নির্ধারণ করে। পরে এক ঘণ্টা পিছিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৭ মিনিট) উৎক্ষেপণের সময় জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওই রাতেও অপেক্ষার অবসান হয়নি।
ওই দিন উৎক্ষেপণ স্থগিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর ফেসবুকে লেখেন, ‘উৎক্ষেপণের শেষ মুহূর্তগুলো কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। হিসাবে যদি একটুও এদিক-সেদিক পাওয়া যায়, তাহলে কম্পিউটার উৎক্ষেপণ থেকে বিরত থাকে। ’
স্পেসএক্স সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শুক্রবার আবার এই স্যাটেলাইট বহনকারী রকেটটি উৎক্ষেপণের চেষ্টা চালাবে জানিয়ে জয় লেখেন, ‘যেহেতু এ ধরণের বিষয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যায় না, সেহেতু উৎক্ষেপণের মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করা খুবই সাধারণ বিষয়, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ’
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দুর্লভ মুহূর্তটি সরাসরি সম্প্রচার ব্যবস্থা থেকে বড় পর্দায় দেশবাসীকে দেখাতে গত বৃহস্পতিবার রাতের জন্য দেশের সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের প্রতি যে নির্দেশ ছিল, তা গত রাতেও বহাল রাখা হয়। এ বিষয়ে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, মেহেরপুর পৌরসভার কমিউনিটি সেন্টারে এবং জেলা প্রশাসকসহ উপজেলা পরিষদের কার্যালয়েও অনুরূপ ব্যবস্থা বৃহস্পতিবারের মতো আজ রাতেও রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রগুলোতেও এ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ ফ্লোরিডার হোটেল থেকে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, রকেট ও স্যাটেলাইটে কোনো সমস্যা নেই। তবে গ্রাউন্ড সিস্টেমে সমস্যা (লঞ্চ প্যাড) হতে পারে। (সূত্র : কালের কণ্ঠ)