ডেস্ক রিপোর্ট : প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনের নাম বদলে যাচ্ছে। বহুল আলোচিত এই আইনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ‘সরকারি চাকুরি আইন-২০১৮’। পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কর্মচারীকে গ্রেফতারের আগে দুদক আইন অনুযায়ী অনুমতি না নেয়ার বিষয়টি বাদ এবং এক বছরের বেশি কারও সাজা হলে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত না করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব প্রস্তাবনাসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত উপ-কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আজ সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠেয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে উপ-কমিটির প্রতিবেদনটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা সংশোধন এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ কর্মচারী চাকরি প্রবিধিমালা অনুমোদনের প্রস্তাব। এই প্রতিবেদন অনুমোদন করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দুদক কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে পারবে না এবং এক বছরের বেশি কারও সাজা না হলে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা যাবে না। এতে সরকারি কর্মচারীদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব সভায় অনুমোদনের জন্য বহুল আলোচিত ‘সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৭’ এর খসড়া উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবিত আইনটির বিভিন্ন ধারা চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনকে প্রধান করে আট সদস্যের উপকমিটি গঠন করে সরকার। পাঁচ দফায় বৈঠক করে ওই কমিটি ২৯টি প্রস্তাবসহ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে। আজকের সচিব কমিটির বৈঠকে ওই প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়া থেকে তিনটি ধারা এবং অনেক উপধারা বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে উপকমিটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- পূর্বানুমতি ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে দুদকের ক্ষমতা সম্পর্কিত আইনের ৪৬ ধারা থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটির উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে করা ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র দায়ের আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে, দুদক আইন-২০০৪ এর ৫ ধারার অধীন গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অনুরূপ পূর্বানুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে না।’ এ ক্ষেত্রে ‘তবে শর্ত থাকে যে, দুদক আইন-২০০৪ এর ৫ ধারার অধীন গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অনুরূপ পূর্বানুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে না।’ অংশটুকু বাদ দিতে প্রস্তাব করেছে উপকমিটি।
ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত কর্মচারীর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া সংক্রান্ত ৪৭ ধারার উপধারা (১) এ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে উপকমিটি। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় এক বছরের অধিক মেয়াদের কোনো কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে অনুরূপ দণ্ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে চাকরি হতে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হবেন।’ উপকমিটি সংশোধন প্রস্তাবে আইন থেকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত’ শব্দটি বাদ দিতে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ নামে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরির উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। কয়েকটি বৈঠক করলেও কোনো খসড়া তৈরি করতে পারেনি তারা। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির একটি খসড়া তৈরি করলেও নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা খসড়া যুগোপযোগী করতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) তৎকালীন যুগ্ম-সচিব (বিধি) মো. ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সালের মার্চে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আইনের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারে মতভেদ দেখা দেয়। বিষয়টি সুরাহা করতে প্রকৃচিসহ (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে সব ক্যাডার ও কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে খসড়া নিয়ে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১২ সালের ৩ জুন ও ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রস্তাবিত খসড়ায় আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে সচিব নিয়োগের বিধান থাকার তীব্র বিরোধিতা করে সব ক্যাডার কর্মকর্তা। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ঘোষণা দেন- সিভিল সার্ভিস আইন নয়, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য একসঙ্গে সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়ন করা হবে।
সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নজমুল ইসলামকে কমিটির প্রধান করা হয়। নানা প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৪ সালের ২১ মে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই বছরের ৩ আগস্ট প্রস্তাবিত খসড়ায় অনুমোদন দেয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি। এর প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই প্রস্তাবিত খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সময় আইনের খসড়ার বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণ পূরণ করতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে আইনের খসড়া নিয়ে যৌথভাবে কাজ শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি) আবদুল হাকিমকে প্রধান করে আরেকটি উপকমিটি গঠন করা হয়।
এই উপকমিটি বিদ্যমান ৪৬টি আইন, বিধিমালা, অনুশাসন ও আদেশাবলীর প্রয়োজনীয় ধারা প্রস্তাবিত খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ওই বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে কিছু পর্যবেক্ষণসহ তা ফেরত পাঠানো হয়। এরপর খসড়া প্রতিবেদনটি ঘষা-মাজা শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ কমিটি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে খসড়া চূড়ান্ত করা হলে গত বছর ৫ ডিসেম্বর প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। সচিব কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে প্রধান করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত এই উপকমিটি গঠন করা হয়। (সূত্র : যুগান্তর)