ডেস্ক রিপোর্ট : ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে বিশ্বজুড়ে ত্রাসের অপর নাম ছিলো মঙ্গোল সাম্রাজ্য। মাত্র দুই শতাব্দী জুড়ে তারা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন অনেক কিছুই সংযোজন করে গেছে, স্থাপন করেছে ধ্বংস ও নৃশংসতার অনন্য নজীর। মধ্য এশিয়ার বৃক্ষহীন তৃণপ্রধান প্রান্তরে যাত্রা শুরু করা মঙ্গোল সাম্রাজ্য উত্তরে সাইবেরিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণে ভারতীয় উপমহাদেশ, ইন্দো-চায়না, ইরান মালভূমি এবং পশ্চিমে লেভান্ত ও আরব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
খুন
চেঙ্গিস খানের বয়স তখন ১৪ বছর। লোকে তখন তাকে চেঙ্গিস খান নামে চিনতো না, চিনতো তেমুজিন নামে। সমকালীন ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, চেঙ্গিসের এক বড় ভাই ছিলো, নাম বেগতার। এই বেগতার প্রায়ই চেঙ্গিসকে নানা বিষয়ে উত্যক্ত করতো। কখনো কখনো সেই উত্যক্তের মাত্রা যেতো সীমা ছাড়িয়ে। বেগতার ও তেমুজিন একে অপরকে সহ্য করতে না পারার আরেকটি কারণ ছিলো যে, তারা ছিলো সৎভাই।
একদিনের কথা, তেমুজিনের পরিবারের কিছু খাবার চুরি করে নিয়ে যায় বেগতার। এ ঘটনার পর যেন আর সহ্য করতে পারলো না কিশোর তেমুজিন। ছোট ভাই কাসারকে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চললো ঘাসের মধ্য দিয়ে। অবশেষে হামলে পড়লো তারা বেগতারের উপর, তীরের পর তীর ছুঁড়ে ঝাঁঝরা করে দিলো তারা বেগতারের দেহটি!
এভাবে প্রায় সময়ই সমস্যা সমাধানের জন্য খুনোখুনিকেই একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিতো চেঙ্গিস খান। তাই প্রায় সময়ই তার শত্রুদের মৃত্যু হতো আকস্মিক।
আরেকবারের কাহিনী শোনাই। তেমুজিন তখনও ক্ষমতার স্বাদ পায় নি। মঙ্গোলদের বিখ্যাত এক রেসলারের নাম ছিলো বুরি। এই বুরি একবার এক ম্যাচে তেমুজিনের ভাই বেলগুতেইকে বেশ অপমান করলো। অপমান ঝাঁজ সেইবার নীরবেই সহ্য করে নিয়েছিলো তেমুজিন; কিছুই বলে নি, শুধু মনে রেখেছিলো।
এরপর একসময় মঙ্গোলদের নেতার আসনে বসে তেমুজিন, হয়ে ওঠে চেঙ্গিস খান। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে বুরিকে তার পাওনা মিটিয়ে দেয়া দরকার বলে মনে করলো চেঙ্গিস খান। তাই বুরিকে বেলগুতেইয়ের সাথে আরেকটি ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ জানায় চেঙ্গিস। এবার বুরির মনে পড়ে যায় অতীতের কথা। ভয় পেয়ে তাই ম্যাচটা স্বেচ্ছায় হেরে যায় বুরি। বেলগুতেই সেদিন তাকে নিয়ে একপ্রকার খেলাধুলাই করেছিলো।
একবার বুরিকে ছুঁড়ে ফেললো বেলগুতেই, এরপর তার উপর চড়ে বসলো সে। ঠিক তখনই চেঙ্গিস খানের এক সিগনালে বদলে গেলো সব। বুরিকে উপুড় করে হাঁটু দিয়ে সজোরে তার পিঠে চাপ দিলো বেলগুতেই। এতক্ষণ ধরে মার খেয়ে খেয়ে বুরির অবস্থা তখন বেশ নাজুক। প্রতিরোধ করার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ততক্ষণে তার নেমে এসেছিলো শূন্যের কোঠায়। এরপরই আসে সেই মরণ কামড়। বুরির মাথাটা ধরে সজোরে ঘুরিয়ে দেয় বেলগুতেই। সাথে সাথেই ভেঙে যায় তার স্পাইন। নিশ্চল বুরিকে এরপর টেনে নিয়ে যাওয়া হয় রিংয়ের বাইরে। সেখানেই অল্প কিছু সময় পর মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেয় বেচারা বুরি।
প্রাণদন্ড
মঙ্গোলদের প্রাণদন্ডের নৃশংসতার কথা শুনলে ভয়ে যে কারো হৃদয় কেঁপে উঠতে বাধ্য। এখন তেমনই কিছু কাহিনী শোনানো যাক।
একবার গুয়ুক খান সন্দেহ করলো যে, ক্ষমতাশীল সভাসদ ফাতিমা হয়তো তার ভাইকে বিষপ্রয়োগ করেছে। মারাত্মক নির্যাতনের মুখে অবশেষে ফাতিমা তা স্বীকার করতে বাধ্য হন। এরপরই তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গুয়ুক। এজন্য প্রথমে ফাতিমার ঠোঁট সেলাই করে বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর তাকে পশমি কাপড়ে মুড়ে ফেলে দেয়া হয় নদীতে!
রাজপরিবারের সদস্যদের রক্ত ঝরানোর ব্যাপারে মঙ্গোলদের এক ধরনের ভীতি কাজ করতো। এজন্য তারা বেছে নিয়েছিলো আরেকটি পদ্ধতি- পিষে ফেলা!
বাগদাদে সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাসিম বিল্লাহকে মঙ্গোলরা প্রথমে গালিচা দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলো। এরপর তার উপর দিয়ে ক্রমাগত নিজেদের ঘোড়া চালিয়ে নিয়ে তাকে শেষ করে দেয় মঙ্গোলরা।
কল্কা নদীর যুদ্ধের পর রাশিয়ান যুবরাজদের মঙ্গোলরা প্রথমে কাঠের তক্তার ভেতরে আটকে রাখে। এরপর সেই তক্তার উপরই তারা বিজয়ভোজ আয়োজন করেছিলো। এভাবেই চাপে দম বন্ধ হয়ে মারা যায় সেই যুবরাজেরা।
তাঙ্গুত এক নেতাকে পিষে মেরে ফেলার আগে চেঙ্গিস খান নির্দেশ দিয়েছিলো ঐ লোকটির নাম পাল্টে শিদুর্কু (অনুগত) রাখার। এতে করে পরজন্মেও সেই নেতা মঙ্গোলদের আনুগত্য প্রদর্শন করবে!
আবার একবার পারস্যের এক যোদ্ধাকে ভেড়ার চর্বি দিয়ে প্রথমে সারা শরীর মাখানো হয়েছিলো। এরপর তাকে হাত-পা বেঁধে, পশমি কাপড়ে মুড়ে ফেলে রাখা হয় তপ্ত রোদের নিচে। এভাবেই মারা গিয়েছিলো সেই যোদ্ধা।
ষড়যন্ত্র
ষড়যন্ত্রের বেলায় মঙ্গোলরা ছিলো সিদ্ধহস্ত। এক্ষেত্রে তৎকালীন দুনিয়ায় তাদের জুড়ি মেলা ছিলো ভার। একটা ঘটনা বললেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা।
তখন মঙ্গোলদের নেতৃত্বে ছিলো স্বয়ং চেঙ্গিস খান। তেব তেংরি নামে এক ওঝা নিজেকে নেতার আসনে দেখার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলো। তাই প্রথমে একে একে সে চেঙ্গিসের ভাইদের সরানোর কৌশল বেছে দেয়।
প্রথমেই সে ঘোষণা দেয় এই বলে যে, সে ভবিষ্যৎ গণনা করে দেখতে পেয়েছে যে চেঙ্গিসের ভাই কাসার একদিন তাকে সরিয়ে নিজেই ক্ষমতা দখল করে বসবে। এমন কথা শুনে ক্ষেপে যায় চেঙ্গিস। তাই সাথে সাথেই বন্দী করা হয় কাসারকে। এরপর কাসারের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত আসা ছিলো সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কাসারের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। নিজের ছেলেদের এমন দ্বন্দ্বের কথা শুনে ছুটে গিয়েছিলেন তাদের মা হলুন। রাতের অন্ধকারে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তিনি ছুটে যান চেঙ্গিসের তাঁবুতে। চেঙ্গিস কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি কাসারকে বাঁধন মুক্ত করেন। এরপর এক টানে নিজের স্তন উন্মুক্ত করে নিজের সন্তানদের কাছে তিনি জানতে চান এককালে যে স্তনের দুধ খেয়ে তারা দুই ভাই বড় হয়েছিলো সেই স্তন আজ তারা চিনতে পারে কিনা! মায়ের এমন সুতীব্র অপমানে মুখ কালো হয়ে যায় চেঙ্গিসের। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সহোদরকে ছেড়ে দেয় সে।
নারীদের দুরবস্থা
মঙ্গোল রাজত্বকালে বেশ কয়েকজন নারীই ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করেছিলেন। তবে নারী জাতির দুরবস্থা বিরাজমান ছিলো পুরো রাজত্বকাল ধরেই।
বাইরের রাজ্যে যুদ্ধশিবির স্থাপনরত অবস্থায় যেসব নারী মঙ্গোলদের হাতে ধরা পড়তো, তাদেরকে জোর করে বিয়ে দেয়া হতো মঙ্গোল পুরুষদের সাথে। কখনো আবার বাধ্য করা হতো কারো উপপত্নী হিসেবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে। প্রায় সময়ই নিজেদের অধীনস্ত লোকদের কাছ থেকে অবিবাহিত সুন্দরী তরুণীদের তারা ‘উপহার’ হিসেবে দাবী করতো!
অ্যালকোহলে আসক্তি
দরিদ্র মঙ্গোলদের কাছে অ্যালকোহলের স্বাদ পাওয়া ছিলো সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা মূলত মাদি ঘোড়ার গাজানো দুধকেই উত্তেজক পানীয় হিসেবে পান করতো। তবে তাতে অ্যালকোহলের মাত্রা ছিলো বেশ কম। আবার সারা বছর ঘোড়ার দুধ পাওয়াও যেত না।
চেঙ্গিস খান ক্ষমতায় আসার পর বদলাতে শুরু করে দৃশ্যপট। মঙ্গোল রাজ্যে তখন যেন ধন-সম্পদের বন্যা বইতে শুরু করে দেয়। আস্তে আস্তে এ প্রাচুর্য অলস করে তোলে মঙ্গোলদের। মদ হয়ে ওঠে তাদের নিত্যদিনের অত্যাবশ্যকীয় পানীয়। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর সময় মঙ্গোলদের অন্যতম বড় শত্রুর নাম ছিলো মদ।
খোদ চেঙ্গিসের পরিবারও রক্ষা পায় নি মদের করাল গ্রাস থেকে। তলুই ও ওগেদেই নামে তার দুই ছেলের মৃত্যুর পেছনে কাজ করেছে অত্যাধিক পানাসক্তি। তাদের আরেক ভাই চাগাতাই খান নিজের চাকরদের এ নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তারা যেন তাকে দিনে কয়েক কাপের বেশি অ্যালকোহল না দেয়।
চেঙ্গিস খানের পর মঙ্গোলদের নেতৃত্বে বসে তার তৃতীয় ছেলে ওগেদেই খান। মদ্যপানের নেশাটা তার ছিলো মাত্রাতিরিক্ত। পারস্যের ঐতিহাসিক আতা-মালেক জুভায়নির মতে, ওগেদেই রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন মাতাল অবস্থাতেই। তার মন্ত্রী ইয়েলু চুকাই তাকে নিয়মিতই প্রতিজ্ঞা করাতেন কম পানের জন্য। কিন্তু ওগেদেই কখনোই সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারতেন না। এর পেছনে অবশ্য ওগেদেইয়ের স্ত্রী তোর্জিনের ইন্ধনও বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিলো। তোর্জিন চাইতো তার স্বামী যাতে মাতাল থাকে। কারণ তাহলে ক্ষমতার স্বাদটা ভোগ করতে পারতো সে!
ইউরোপীয় সন্ন্যাসী উইলিয়াম একবার তার নাতি মংকে-কে দেখতে গিয়েছিলেন মঙ্গোল রাজ্যে। তখন তাদের মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তি তাকে অবাক না করে পারে নি। তিনি সেখানে রুপার তৈরি একটি গাছ দেখেছিলেন যা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো চারটি নল। ওয়াইন, রাইস ওয়াইন, মধু ও পানির গাজন থেকে প্রস্তুত একপ্রকারের সুরা ও মাদি ঘোড়ার গাজানো দুধ বেরিয়ে আসছিলো সেই চারটি নল থেকে!
যে অপহরণ বদলে দিয়েছিলো সবকিছু
১১৭৮ সালের কথা, বোর্তে নামক এক নববিবাহিতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় মার্কিদ গোত্রের লোকেরা। বোর্তের জামাই কে ছিলো জানেন? তেমুজিন, লোকে যাকে একদিন চেঙ্গিস খান নামেই চিনতে যাচ্ছিলো!
নিজের স্ত্রীকে এভাবে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে তেমুজিন। কয়েকজন লোক নিয়ে সে হামলা করে বসে মার্কিদদের, উদ্ধার করে আনে প্রিয়তমা স্ত্রীকে। এ আক্রমণ তেমুজিনকে অকুতোভয় এক যোদ্ধা হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পাইয়ে দেয়। অনেকের মতে এ আক্রমণই তেমুজিনের জন্য ভবিষ্যতে ‘দ্য গ্রেট খান’ হবার পথ সুগম করে দিয়েছিলো।
তবে ঝামেলা বেধে যায় অন্য জায়গায়। তেমুজিন যখন বোর্তেকে উদ্ধার করে আনে, তখন তিনি ছিলেন কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কেউই নিশ্চিত ছিলো না যে এ সন্তানের প্রকৃত পিতা তেমুজিন নাকি মার্কিদদেরই কোনো ধর্ষক। এসব আমলে না নিয়ে তেমুজিন অবশ্য গর্ভের সন্তানকে নিজের বলেই মেনে নেন। তবে সমাজ তা মেনে নেয় নি।
অনেক বছর পরের কথা। চেঙ্গিস খানের বয়স হয়ে গেছে। নিজের যোগ্য উত্তরসূরি নির্বাচিত করা যাবার অভিপ্রায়ে পরিবারের সদস্যদের ডাকা হলো। স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী চেঙ্গিসের বড় ছেলে জোচিরই পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এতে বাদ সেধে বসে খানের দ্বিতীয় ছেলে চাগাতাই। ‘মার্কিদদের জারজ ছেলে’কে মঙ্গোলদের নেতার আসনে দেখতে সে ছিলো নারাজ। এভাবে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক।
বাবার অনুরোধ সত্ত্বেও থামে নি ছেলেদের বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষমতার ভার তুলে দেয় দ্য গ্রেট খানের তৃতীয় ছেলে মদ্যপ ওগেদেই খানের হাতে। তবে এ নিয়েও তাদের মাঝে অশান্তি চলতেই থাকে। এ বিতর্কই এককালে ভাঙন ধরিয়ে দেয় মঙ্গোল সাম্রাজ্যে।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
চেঙ্গিস খানের পর মঙ্গোলদের নেতার আসনে বসেছিলো তার ছেলে ওগেদেই খান। মূল ঝামেলাটা বাধে ১২৪১ সালে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ওগেদেইয়ের মৃত্যুর পরেই। এরপর ক্ষমতা দখল নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাঝে শুরু হয়ে যায় দীর্ঘকালীন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
ওগেদেইয়ের পর মঙ্গোলদের নেতৃত্বের হাত নিজের হাতে তুলে নেয় তার স্ত্রী তোর্জিন। পাঁচ বছরের শাসনকালে ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে সে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজায় যাতে মঙ্গোলদের পরবর্তী নেতা হয় তার অকর্মন্য ছেলে গুয়ুক খান। আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ানোর ইচ্ছা ছিলো তার।
এ লক্ষ্যে চেঙ্গিসের জীবিত ভাই তেমুজকেও চিরতরে শেষ করে দেয় তোর্জিন। তবে দুর্ভাগ্য বেচারির। কারণ যে ক্ষমতার স্বপ্ন নিয়ে নিজের ছেলেকে সে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো, সেই স্বপ্নই তাকে ব্যাকফায়ার করে বসে। মায়ের হাতের পুতুল হতে ইচ্ছা করে নি গুয়ুকের। তাই একে একে তোর্জিনের উপদেষ্টাদের খতম করে দেয় সে। এরপর এককালে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটে তোর্জিনেরও!
দুই বছর পর হঠাৎ করে মারা যায় গুয়ুক খান নিজেও। তখন ক্ষমতা নিয়ে ঝিমিয়ে পড়া দ্বন্দ্ব আবারো নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। জোচি আর তলুই খানের বংশধরেরা জোট বাঁধে তলুইয়ের ছেলে মংকে-কে রাজ সিংহাসনে বসাতে। ওদিকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় চাগাতাই ও ওগেতেই খানের বংশধরেরা। এ লক্ষ্যে তারা শুরু করে দেয় বিদ্রোহ। আর এ বিদ্রোহীদের দমাতে মংকে খানও উঠেপড়ে লেগে যান।
ওগেদেই ও গুয়ুকদের মন্ত্রীদের গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেয়া হয় পরপারে। অন্যদিকে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে চিরুনি অভিযান চালানো হয় পুরো মঙ্গোলিয়া জুড়ে, বন্দী করা হয় ওগেদেই রাজপুত্রদের। ওগেদেই পক্ষের অনুসারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চাগাতাই ও ওগেতেই পক্ষের লেগে যায় বেশ কয়েক বছর। ততদিনে সিংহাসনে নিজেদের আসনটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলো তলুই খানের বংশধরেরা।
গৃহযুদ্ধ
গুয়ুক খানের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে আর অল্প হলেই গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছিলো মঙ্গোলীয়দের মাঝে। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত এক ভোজ অনুষ্ঠানে জোচির ছেলে বাতুর সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে তাকে ‘কেবলই এক বৃদ্ধ নারী’ বলে সম্বোধন করে বসে গুয়ুক। এতে পৌরুষে আঘাত পায় বাতু। এরপর থেকেই তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
কিছুদিন পর যখন গুয়ুক খান সিংহাসনে বসে, তখন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে মঙ্গোলিয়া যেতে অস্বীকৃতি জানায় বাতু। এতে মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের সেনাবাহিনী জড়ো করে বাতুকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে গুয়ুক খানের বাহিনী। তবে পথিমধ্যে গুয়ুক খানের মৃত্যুর জন্যই এড়ানো সম্ভব হয় সেই যুদ্ধ।
তবে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা তাতে শেষ হয়ে যায় নি। মংকে খানের মৃত্যুর পর আবারো একই সমস্যা দেখা দেয়। সেইবার বিশাল গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে মঙ্গোলিয়ার শাসনভার নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করে নেয় মংকের দুই ভাই কুবলাই খান ও আরিক বোকে। ওদিকে তাদের এ অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে নিজেদের শক্তিশালী করে প্রেক্ষাপটে ফিরে আসে ওগেদেই খান ও চাগাতাই খানের বংশধরেরা।
অন্যদিকে জোচি আর হালাকু খানের বংশধরেরা পৃথক হয়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমে, যা পরিচিতি পায় ‘গোল্ডেন হোর্ড’ ও ‘ইলখানাতে’ নামে। এসব বিবাদের পর মঙ্গোল সাম্রাজ্য কখনোই আর পুরোপুরি মনেপ্রাণে এক হতে পারে নি।
ধর্মীয় ব্যবস্থা
চেঙ্গিস খান টেংরিজমের অনুসারি ছিলো। এ ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল বৈশিষ্ট্যের মাঝে রয়েছে ওঝায় বিশ্বাস, প্রকৃতি পূজা, মানবপূজা, নিজেদের পূর্ব পুরুষদের পূজা এবং একইসাথে একেশ্বরবাদ ও বহু ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন! চেঙ্গিস খান একইসাথে মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধদের কাছ থেকেও ধর্মীয় ব্যাপারে পরামর্শ নিতো।
অবশ্য চেঙ্গিসের শাসনামল থেকেই মুসলিমদের হালাল কোরবানী পদ্ধতি নিষিদ্ধ করে তাদের উপর মঙ্গোলীয়দের নিজস্ব কোরবানী পদ্ধতি চাপিয়ে দেয়া হয়। মুসলিমরা তখন খুবই গোপনে ভেড়া জবাই করতো। মুসলিম আর ইহুদীদের চেঙ্গিস সরাসরি ‘ক্রীতদাস’ বলেই সম্বোধন করতো। খাবারদাবারের বেলাতেও স্বীয় ধর্মের হালাল-হারামের নীতি বাদ দিয়ে মঙ্গোলদের নীতি অনুসরণ করতে বলা হতো তাদের। সেই সাথে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিলো খৎনা করার রীতিও।
১২১৮ সালে বুখারা বিজয়ের পর ভয়ে কম্পমান জনতার উদ্দেশ্যে মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে চেঙ্গিস খান বলেছিলো, “তোমরা অনেক পাপ করেছ। … তোমরা যদি এত বড় বড় পাপ না করতে, তাহলে সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার মতো এক আজাবকে তোমাদের কাছে পাঠাতেন না!”
অনেক বছর পর চেঙ্গিসের নাতি গুয়ুক খান পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টকে প্রায় একইরকম ভাষায় আরেকটি চিঠি লিখেছিলো, “চিরন্তন ঈশ্বরের ক্ষমতাকে জানাচ্ছি ধন্যবাদ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ভূমিই দেয়া হয়েছে আমাদের। তোমরা যদি ঈশ্বরের আদেশ মেনে না চলো এবং আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করো, তাহলে জেনে রেখো তুমিও আমাদের শত্রু বলেই গণ্য হবে।”
ফ্রান্সের রাজা লুইসকে উদ্দেশ্য করে মংকে খান লিখেছিলেন, “স্বর্গে কেবল একজন চিরন্তন ঈশ্বর আছেন, আর পৃথিবীতে আছে কেবলমাত্র একজন সর্বময় কর্তা, চেঙ্গিস খান! … যখন চিরন্তন ঈশ্বরের গুণে ভাস্বর হয়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবী শান্তি ও আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে, তখন প্রকাশিত হবে আমরা কেন এসেছি।”
তথ্যসূত্র
১) The Secret History of the Mongols: The Origin of Chinghis Khan
২) en.wikipedia.org/wiki/Genghis_Khan
৩) en.wikipedia.org/wiki/Mongol_Empire
৪) en.wikipedia.org/wiki/Möngke_Khan
৫) en.wikipedia.org/wiki/Güyük_Khan