স্টাফ রিপোর্টার :
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়’। ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি নদীর অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় আবার আসতে চেয়েছিলেন এই নদী তীরে। হয়তো কবির দৃষ্টি আগাম দেখতে পেরেছিল আজকের ধানসিঁড়ির ছবি। আর তাই তিনি জাহাজ, লঞ্চ কিংবা নৌকায় নয়, শঙ্খচিল শালিকের বেশে নদী তীরে আসার কথা বলেছিলেন। সেই নদী দিনে দিনে নাব্যতা হারিয়ে মিলিয়ে গেছে জমির সাথে। ক্রমে ক্রমে শীর্ণ হয়ে পড়ায় ধানসিঁড়ি এখন ছোট খালে পরিণত হয়েছে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ ধানসিঁড়ি নদী ভরাট হয়ে এখন চার কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকেছে। নদীর তলদেশে পলি জমে বর্তমানে শীত মৌসুমে পানিপ্রবাহও বন্ধ রয়েছে রূপসী বাংলার এই নদীতে। দূর-দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থীরাও আজ ধানসিঁড়ি নদী দেখতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
ধানসিঁড়ি নদীর ইতিহাস :
ধানসিঁড়ি নদীর প্রথম নাম ছিল ধানসিদ্ধ নদী। অনেকের মতে, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার দিকে বয়ে যাওয়া এ নদীটি পারাপারে এক ডোঙ্গা ধান সিদ্ধ হওয়ার সমপরিমান সময় লাগতো বলে এর নাম ছিল ধানসিদ্ধ নদী। আবার কেউ কেউ বলেন, রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি এলাকায় তৎকালীন সময়ে শ শ ডোঙ্গায় ধান সিদ্ধ করা হতো। বিভিন্ন স্থানের লোকজন এখানে ধান সিদ্ধ করার জন্য নৌকায় করে ধান নিয়ে আসতো। এ কারণেই এ নদীর নাম ধানসিদ্ধ নদী। উপজেলার বিষখালী নদীর মোহনা থেকে শুরু হয়ে মাঝখানে জাঙ্গালিয়া নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার বিষখালীতেই ধানসিঁড়ির শেষ। জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি কবিতার মাধ্যমেই এই নদীর নাম বদলে ধানসিদ্ধ থেকে ধানসিঁড়ি করা হয়। সেই থেকেই ধানসিঁড়ি নামে নদীটি পরিচিত। স্টিমারযোগে জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় পড়াশুনা ও চাকরির সুবাদে এ নদীর বুক দিয়ে যাতায়াত করতেন। তখন নদীর দু’ধারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য কবি খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচির আওতায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নদীটির নাব্যতা রক্ষার জন্য কিছু অংশ খনন করা হয়েছিল। এরপর অযত্ন-অবহেলায় নদীটি রক্ষাকল্পে আর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সড়কপথ তৈরির আগে ঝালকাঠি জেলা সদরের সাথে রাজাপুর উপজেলার সব ধরনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ধানসিঁড়ি নদী। অতীতে এই নদী দিয়ে এক্রপ্রেস সার্ভিসের স্টিমার খুলনা হয়ে কলকাতায় যেত। বড় বড় মালবাহী পালতোলা নৌকা এবং সাম্পানও চলাচল করত ধানসিঁড়ি নদীতে। দুই যুগ আগেও ধানসিঁড়ি নদী থেকে লঞ্চ ও কার্গো চলাচল করতো। রাজাপুর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ ঝালকাঠির সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক রুট হিসেবে এই নদীপথটিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। এই নদী হয়েই সহজ ও কম সময়ে ঝালকাঠি থেকে ব্যবসায়ীরা মালামাল দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় পৌঁছাতেন। নদীর দুই পাশেই ফসলের মাঠ। ছিল নানা প্রজাতির গাছ। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। শব্দগুলো যখন কান ছুয়ে মনে লাগতো ভ্রমনকারীদের। এমন সৌন্দর্যময় নদীর সাথে জড়িয়ে আছে কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি।
বর্তমান অবস্থা :
বর্তমানে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার পাড়েরহাট এলাকা থেকে ভরাট হয়ে ধানী জমির সঙ্গে মিশে গেছে ধানসিঁড়ি নদীর বাকি অংশ। নদীর তলদেশে পলি জমে ভরাট ও দখলদারিত্বের ছোবলে ধীরে ধীরে ধানসিঁড়ি এখন শীর্ণ সরু খালে পরিণত হয়েছে। এই খাল থেকে এখন নৌকা চলাচলও করতে পারছে না। যেখানে পানি থাকে সেখানেও কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও আবার শুকিয়ে আটকা পড়ে আছে নৌযান। গত দুই বছর আগে এই নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করার জন্য খনন কাজের জন্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এই প্রকল্পে খালের পাড় পরিস্কার ছাড়া আর কোন কাজে আসেনি সেই বরাদ্দ। নদী তীরে গড়ে উঠেছে আবাস। ধানসিঁড়ি নদী খাল হয়ে যাওয়ায় প্রকৃতি ও কবিতাপ্রেমিক অনেক পর্যটক এখানে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
ধানসিঁড়ি পাড়ের বাসিন্দা তমিজউদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের ছোট বেলায় এই নদীতে আমরা স্টিমার চলতে দেখেছি। এখন আর নৌকাও চলাচল করতে পারে না নদীতে। তারপরও যতটুকু আছে তা টিকিয়ে রাখতে হলে ভালভাবে খনন ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই।’
স্থানীয় কৃষক আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘আমরা এই খালের পানি থেকেই হাজার হাজার কৃষক মাঠে ফসল ফলাই। শীতকালে নদীতে পানি না থাকার ফলে আমারা চাষাবাদ করতে পারছি না’
রাজাপুর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সোহরাব হোসেন বলেন, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে মোল্লাবাড়ী, বাড়ৈবাড়ী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রাজাপুর উপজেলার হাইলকাঠি, ইন্দ্রপাশা ও বাঁশতলা গ্রামের বুক চিড়ে মোট ৮.৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে রাজাপুরের জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনায় মিলেছে ধানসিঁড়ি। কবি এই জাঙ্গালিয়া নদীকে কবিতায় জলাঙ্গী বলেছেন। বর্তমানে ধানসিঁড়ি বেহাল অবস্থা হলেও এই নদীর রূপ কবি জীবনানন্দ দাশের মতো আজো বিমহিত করে প্রকৃতিপ্রেমি মানুষদের। তাই কবির স্মৃতি বিজরিত ঐতিহ্যবাহী ধানসিঁড়িকে বাঁচিয়ে রাখতে এলাকাবাসী ও সরকারের ইচ্ছার কোন কমতি নেই। কিন্তু অর্থলোভী কিছু মানুষের কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি আজ ধানসিঁড়ি।
জীবনানন্দ দাশ ও ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করে আসছেন সাংবাদিক আমিন আল রশীদ। ধানসিঁড়ি নদীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে অসংখ্যবার সংবাদ প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। কখনো ইতিহাস নিয়ে, কখনো বর্তমান অবস্থা নিয়ে। শত চেষ্টা করেও এই নদীর চীরচেনা রূপ ফিরিয়ে আনতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নদীর সেই পূর্বের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন খনন করা। শুধু নামেমাত্র খনন করলেই হবে না। নদী প্রসস্ত করে খনন করে কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি ধরে রাখার আহ্বান জানান তিনি।
রাজাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজ উল্লাহ্ বাহাদুর বলেন, ধানসিঁড়ির দুপাড়ে শত শত হেক্টর উর্বর ফলসি জমি থাকলেও নদীতে পানি প্রবাহ না থাকায় কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারছে না। নদীটিতে যদি পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা যেত তাহলে ধান ও রবি শষ্যের ব্যপক আবাদ করা যেত।
এ বিষয়ে রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা বেগম পারুল বলেন, ‘ধানসিঁড়ি নদীর সাথে বহু ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। তাই ধানসিঁড়ি খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবর সুপারিশপত্র দেওয়া হবে। বরাদ্দ পেলেই খনন কাজ শুরু হবে।