ডেস্ক রিপোর্ট : সরকারি চাকরিতে কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করাসহ ৫ দফা দাবিতে চলমান আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা প্রত্যাহার করেছে আন্দোলনকারীরা।
দ্বিধাবিভক্ত আন্দোলনকারীরা ফের একত্র হয়ে আন্দোলনে নেমেছে। কোটা সংস্কার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা, গ্রেফতারকৃত সবার মুক্তি, আহতদের চিকিৎসার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কোটা সংস্কার আন্দোলনবিষয়ক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বিকালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ফের বিক্ষোভে নামে।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে আন্দোলনকারীদের মূল কমিটি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন ডাকে। সেখানে ঘোষণা দেয়া হয়, বিকাল ৫টার মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর দেয়া বক্তব্য প্রত্যাহার না হলে সারা দেশে ফের অবরোধ শুরু হবে। কিন্তু দাবি অনুযায়ী বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে পুনরায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা, উপজেলা, কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও টানা অবরোধের ডাক দেয়া হয়। এরপর সেখান থেকে একটি মিছিল বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের যে অংশটি কর্মসূচি স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল তারাও মূল কমিটির সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। এতে করে আন্দোলনে বিভক্তি দূর হয়। এই অংশটি সকাল থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল। রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আগত এই আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। পরে আন্দোলনরত অবস্থায় এই অংশটি ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সেখান থেকে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্য হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যায়।
বিকালের সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, মতিয়া চৌধুরী আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিকাল ৫টার মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তা করেননি। তাছাড়া অর্থমন্ত্রী ‘আসন্ন বাজেটের আগে কোটা সংস্কার হবে না’ এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা সোমবার সরকারের সঙ্গে আলোচনার বিপরীত। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কারের বিষয়ে বক্তব্য দেবেন না, তত দিন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এর আগে সকালের সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্যের বাসভবনে হামলাকারীদের বহিরাগত দাবি করে রাশেদ খান বলেন, আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নয়। পাশাপাশি আন্দোলন করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে যেন কোনো আন্দোলনকারীকে বের করে দেয়া না হয় সে জন্য অনুরোধ করা হয়। সোমবার কর্মসূচি স্থগিত হলে বিভিন্ন হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করার পর- যুগ্ম সমন্বয়কের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য এলো।
সোমবার সংসদে মতিয়া চৌধুরী কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন- “মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে?”
আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ থেকে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ -এর সুনির্দিষ্ট ৫টি দাবি তুলে ধরেন। দাবিসমূহ হলো- কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা; কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে খালি থাকা পদগুলোতে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া; কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেয়া; সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একবারের বেশি ব্যবহার না করা।
এদিকে কোটার সার্বিক সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে রাজু ভাস্কর্য স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। তাদের স্লোগান ছিল- ‘মতিয়ারে মতিয়া, তুই রাজাকার তুই রাজাকার’, ‘ম-তে মতিয়া, তুই রাজাকার তুই রাজাকার’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নেই’, ‘কোটা দিয়ে কামলা নয়, মেধা দিয়ে আমলা চাই’, ‘এক দফা এক দাবি, কোটা প্রথার সংস্কার চাই’, ‘বাতিল করো বাতিল করো, নাতি-পুতি কোটা কোটা বাতিল করো’, ‘আমাদের দাবি আমাদের দাবি, মানতে হবে মেনে নাও’।
এর আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে মানববন্ধন করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। পরে আবার ২৫ ফেব্রুয়ারি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেন তারা। ৩ মার্চের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান দাবি করে। সমাধান না হওয়ায় আবার আন্দোলনে নেমেছেন তারা। এই সময়ে দাবি পূরণ না হওয়ায় ৪ মার্চ রাজধানীর শাহবাগে কোটা সংস্কার চেয়ে বিক্ষোভ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী। দাবি আদায়ে ১৪ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও স্মারকলিপি প্রদানের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।
পাশাপাশি ওইদিন সারা দেশের সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু ঢাকা শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এতে ১৬ জন আহত হয় এববং ৬৩ জনকে আটক করা হয়। পরে দেশব্যাপী ছাত্র বিক্ষোভের মুখে রাত ৯টার দিকে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। পরে সেদিনই এই ঘটনায় আন্দোলনকারী অজ্ঞাতনামা ৭০০-৮০০ জনের নামে মামলা দায়ের করা হয়।
এরপর মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারীরা। ১৮ মার্চ মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ২৫ মার্চ গলায় শিক্ষা সনদ ঝুলিয়ে রাস্তা পরিষ্কার কর্মসূচি পালন করে দাবি আদায়ে এক অভিনব প্রতিবাদ জানান চাকরিপ্রার্থী বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এছাড়া ১ এপ্রিল থেকে ৭ এপ্রিল ছিল ‘কোটা সংস্কার সচেতনতা সপ্তাহ’।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। আর বাকি ৪৪ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধায়। এ জন্য এই কোটা ব্যবস্থার সার্বিক সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা।