স্টাফ রিপোর্টার :
সাংবাদিক হেমায়েত উদ্দিন হিমু ছিলেন একজন বিনয়ী ও সজ্জন ব্যক্তি। গুণি ও আদর্শবান সাংবাদিক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর যে মানবিক গুনাগুন ও চারিত্রিক মাধুর্য ছিল সেটা অনন্য। সারল্য তাঁর চোখের দীপ্তিতে, তাঁর হাসির প্রভায় লেগে থাকত। ঝালকাঠির প্রবীণ সাংবাদিক বিটিভির জেলা প্রতিনিধি, প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য হেমায়েত উদ্দিন হিমুর মৃত্যুতে শোকসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সবাই তাঁর সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারি এবং প্রজ্ঞার প্রশংসা করছেন। তাঁর কর্মময় জীবনের আদর্শবান কাজগুলো সহকর্মীদের ধারণ করার আহ্বান জানান বক্তারা। শনিবার সকাল ১১টায় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এ শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। গত ১১ মার্চ রাতে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিক হেমায়েত উদ্দিন হিমু ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক সভা ও দোয়া মোনাজাতের আয়োজন করে প্রেস ক্লাব। শোকসভায় হিমুর কর্মময় জীবনের নানা স্মৃতিচারণ করেন বক্তারা।
ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের সভাপতি কাজী খলিলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে হিমুর স্মৃতিচারণ করেন জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও হিমুর বন্ধু অ্যাডভোকেট খান সাইফুল্লাহ পনির, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমান, বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার সাহা, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আনু, সদর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান ইসরাত জাহান সোনালী, প্রেস ক্লাবের দাতা সদস্য অধ্যাপক ড. কামরুন্নেছা আজাদ, প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য মনোয়ার হোসেন খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক দুলাল সাহা, প্রয়াত হিমুর ছোট ভাই হাচান মাহমুদ, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মানিক রায়, সহসাধারণ সম্পাদক কে এম সবুজ ও সদস্য অলোক সাহা। অনুষ্ঠানে হিমুর বড় ছেলে জান্নাতিন নাঈম দিপ উপস্থিত ছিলেন। পরে দিপের হাতে প্রেস ক্লাবের কল্যাণ তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। শোকসভায় প্রায়ত হিমুর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মোনাজাত করেন প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মু. আব্দুর রশীদ।
শোকসভায় উপস্থিত ছিলেন ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের দাতা সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজাদ হোসেন পান্না ও ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের সদস্যরা।
সাংবাদিকতায় হিমু : দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন সাংবাদিক হেমায়েত উদ্দিন হিমু। ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি সাংবাদিকতায় জড়িত।
তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) জেলা প্রতিনিধি এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল সূর্যালোক নিউজ এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও টেলিভিশন সাংবাদিক সমিতির সভাপতি। এর আগে তিনি দৈনিক যুগান্তরে ১৭ বছর, দৈনিক বাংলা, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ, দৈনিক দেশ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি), এসোসিয়েটেড প্রেস অব বাংলাদেশ (এপিবি), নিউজ মিডিয়া, মিডিয়া সিন্ডিকেট, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করেন। তিনি ১৯৯২ সালে ঝালকাঠি থেকে সাপ্তাহিক সূর্যালোক পত্রিকা বের করেন। ওই পত্রিকার তিনি সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। হিমু বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ফিচার সার্ভিসে বহুদিন ধরে ফিচার লিখছেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি), গণমাধ্যম বিষয়ক সংস্থা ম্যাস্-লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি) এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দীর্ঘদিন যাবত সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
সামাজিক কর্মকাণ্ডে হিমু :
ঝালকাঠি সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক (টিআইবি পরিচালিত) এর সভাপতি ছিলেন হিমু। এডাব, ঝালকাঠি জেলা শাখা সভাপতি, সূর্যালোক ট্রাস্ট্রের নির্বাহী পরিচালক, মাল্টিপার্টি অ্যাডভোকেসি ফোরামের (ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত) সভাপতি, ওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, শেরে বাংলা স্মৃতি একাডেমি, ঢাকার আজীবন সদস্য, সেতু যুব সমিতি-ঝালকাঠির আজীবন সদস্য, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) সদস্য ছিলেন তিনি।
লোক সংস্কৃতি : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘সারা দেশের লোক সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা’ এর আওতায় ‘ঝালকাঠির লোক সংস্কৃতি’ বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ ও লেখা এবং ছবি তোলা ও ছবি সংগ্রহ কাজে অংশগ্রহণ (এ সংক্রান্ত ‘পান্ডুলিপি’ প্রকাশনার জন্য শিল্পকলা একাডেমিতে জমা রয়েছে)।
চক্ষুদান : মানবকল্যাণের জন্য ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন।
রক্তদান : অসহায় মানুষের জন্য ২৮ বার স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন (রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ)।
সাহিত্যাঙ্গণ : বিভিন্ন সময় তাঁর সম্পাদনায় সাহিত্য সংকলন, ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা অসংখ্য ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
ফুটবল : ঝালকাঠি সরকারি স্কুলের ফুটবল টিমের খেলোয়াড় হিসেবে ঝালকাঠি-বরিশালের টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ।
প্রশিক্ষণ : বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থা থেকে মানবাধিকার, সুশাসন, অ্যাডভোকেসি, ম্যানেজমেন্ট, পরিবেশ, এনজিও কার্যক্রম, আর্সেনিক, এইচআইভি/এইডস, সমাজ উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাংগঠনিক দক্ষতা উন্নয়নসহ নানা বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
পারিবারিক তথ্য : পিতা হাবিবুর রহমান ঝালকাঠি শহরের বিশিষ্ট আলোকচিত্র শিল্পী ছিলেন। মা সফুরা বেগম গৃহিণী। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় হিমু। স্ত্রী ইয়াসমীন আক্তার কচি ঝালকাঠির শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সম্পাদিকা। দুই পুত্র সন্তানের মধ্যে জান্নাতিন নাঈম দীপ ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতায় ‘মাস্টার্স’ করে, মিডিয়া প্রোডাক্টশন কোম্পানি ‘সূর্যালোক ফিল্মস’ এর পরিচালক পদে কাজ করছে এবং আশিক হৃদয় অর্ক কুস্টিয়া ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ের অনার্সের (ম্যানেজমেন্ট) শিক্ষার্থী।
হিমুর যত পুরস্কার :
হেমায়েত উদ্দিন হিমু ছিলেন একজন গুণী ও প্রতিথযশা সাংবাদিক। তিনি সাংবাদিকতা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ভালো কাজের স্বীকৃতিতে পেয়েছেন পুরস্কারও। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির গুণীশিল্পী সম্মাননা-২০১৫ (ফটোগ্রাফি) পেয়েছেন, সাংবাদিকতা ও গবেষণায় ২০১৩ সালে ঢাকাস্থ শেরে বাংলা স্মৃতি একাডেমি পদক, ২০০৯ সালে ঝালকাঠি জেলা পল্লী চিকিৎসক কল্যাণ সমিতির ‘শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকতা পুরস্কার’, সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘প্রতিভা-ললিত বাবু স্মৃতি গুণীজন সম্মাননা-১৪২২ বঙ্গাব্দ’, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) সহায়তায় পটুয়াখালী প্রেস ক্লাব-পটুয়াখালী সাংবাদিক সমিতির উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত সাংবাদিকদের ‘সংবাদ লেখা’ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ, ঝালকাঠি সরকারি কলেজে পড়াশোনাকালে বার্ষিক সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন এবং ছাত্রজীবনে বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অসংখ্য পুরস্কার লাভ।