মুহাম্মাদ ইমাদুল হক ফিরদাউছ প্রিন্স :
বাবা ছাড়া সন্তানের বাঁচার লড়াইটা অনেকটা নীড়হারা পাখির মতো। এই সংগ্রামটা আট দশটা সন্তানের বেড়ে ওঠা থেকে আলাদা। আহল্লাদে ফেটে পড়া বাবার আদরের ছোট্ট সেই একমাত্র ছেলেটা আজ পরিবারের গুরুদায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। মাঝে মধ্যে অফিসে কাজের চাপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর মনে মনে বলে, ‘আব্বু আপনি থাকলে আজ হয়তো সবকিছু আরেকটু সহজ হতো।’
মানুষকে আল্লাহ অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন। সেই অসাধারণ সুন্দর নিয়ামতের একটি সন্তানের জন্য তার মা-বাবা। বাবা সন্তানের মাথার ওপর যার স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাঁকে, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার তুলনা বাবাই। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রং ও আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবাকেই আদর্শ মনে করে সন্তানেরা। বাবা সন্তানকে শেখান কীভাবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। আজ আমার আব্বু আমাদের মাঝে নেই। আজ ৩ বছর আব্বুকে ছাড়া। আব্বু চলে যাওয়ার পর শিখেছি অনেক বাস্তবতা, দেখেছি অনেক নিষ্ঠুরতা।
আব্বু, আপনাকে খুব ভালবাসি কিন্তু এত দিন সেইটা বুঝতে পারিনি বুজলে কি আপনাকে এত কষ্ট দিতে পারতাম, জানেন আব্বু আপনার ছেলেটা খুব পাগল, সে সহজে নিজের ভাল বুজে না, তাই আপনাদের বলা কথা গুলো কে অন্য ভাবে নিতাম, আসলে আপনার ছেলেটা এমন এই তা তো আপনি যানেন। তাই তো হাজার কথা বলার পর রাগ করতেন না আমার সাথে, শুধু বলতেন এখন বুঝতে পারবি না আমি যখন থাকব না তখন বুজবি, সত্যি বলতে কি আব্বু এখন বুজি আপনার প্রতিটা কথার মানে।
‘আমার আব্বু’—এই দুটি শব্দের মধ্যে নিহিত আছে আব্বুর জন্য আমার বলা না-বলা যত আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, গর্ব; তাঁকে হারানোর কষ্ট আর অশ্রু। আব্বু আমাদের কাউকে কিছু না বলে, কাউকে কিছু করার কোনো সুযোগ না দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কখনো আব্বুর সঙ্গে দেখা হবে না, কথা হবে না এটি আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। সেদিন খবরটা শোনার পরও বিশ্বাস করিনি, ভেবেছি কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে কি না।
আব্বুর সেই পুরনো জামা-পাজামাগুলি আজো আলনায় সাজিয়ে রেখেছেন মা। আব্বুর ব্যবহার করা চশমাটি অতি যত্নে তুলে রেখেছে সুকেশে । মনে হয় এ বুঝি আব্বু এসে মাকে বলবে ‘এই দাও আমার জামা-পাজামা আর চশমাটা’। আর দিনভর আম্মুর অপেক্ষার প্রহরের সাথে আমি আজও যেন প্রতীক্ষায় রয়েছি কখন আব্বুর ফোন এসে ভেজে উঠবে আর স্নেহভরা কন্ঠে বলবে ‘আব্বু’ কেমন আছ? -জানি এ অপেক্ষার শেষ নেই…। অপেক্ষার সাগরে আরো একটি বছর যোগ হয়ে আজ ৩ বছর । ভীষণ মনে পড়ছে আব্বু তোমায় আজ এ মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে…ভীষণ। কেমন আছেন আপনি? কোথায় আছেন আপনি? কি করেন আপনি? জানতে বড় ইচ্ছে হয়! আপনার জন্য আমার বুকের গহীনটায় কেমন যেন পুড়ে দিবারাত্রি। এই সেই জানুয়ারী মাস যে মাসে আপনি শুধু আমাদেরকেই নয় সমস্ত পৃথিবীকেই বিদায় জানিয়ে চলে গেছেন সকল মায়াজাল ছিন্ন করে না ফেরার দেশে। বড় কষ্ট আপনার চলে যাওয়ার সময় কাছে থেকে শেষ বিদায় জানাতে পারিনি…ক্ষমা করেন। যখন আপনাকে দেখলাম তখন আপনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। শত-হাজারো ডেকেছি, আপনাকে ধরে কত কেঁদেছি – শুধু আপনার মুখের একটি বর্ণমালা শুনার জন্য, তা হয়নি – সেজন্য আজও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ থামেনি। আপনি দেখতে পাননি হাজারো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ঠাই নিয়েছেন আপনার আসল বাশের ঘেরা ঘরে। আমার বুকের মাঝে যে কতটুকু ব্যাথা জড়িয়ে আছে যদি আপনি শুনতেন! আব্বু আপনার অনুভূতি, ভালোবাসা, অস্তিত্ব সবসময় যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে, যদিও আপনি আছেন অনেক দূরে, অচীনপূরে। জীবন বহমান। সকল হারানো কিংবা শোক-তাপের ঊর্ধ্বেও জীবন স্বীয় গতিতে চলবে। এটাই চিরন্তন সত্য। স্মৃতি শুধুই স্মৃতি। কিছু স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। কিন্তু স্মৃতিকে যেমন ভুলে থাকা যায় না, তেমনি অস্বীকারও করা যায় না। আমি জানি, আমি আমার আব্বুকে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু আজ আমার সেই ভালোবাসা আমি কাকে প্রদর্শন করব? কাকে আমি সেই প্রিয় ‘আব্বু’ বলে ডাকব? আমার ভাগ্যবিড়ম্বিত এই আক্ষেপ অন্তরের। এই জ্বালা কি কোনো দিন নিভবে?
আহ! আজ দিন চলে গেছে। আমি আব্বুহীন অসহায়। আমার পথের চার দিক তিমিরে ঘেরা। আমাকে আপন করে আর কেউ ভালোবাসে না। আব্বুর মতো মমত্ব নিয়ে কেউ তো আর এল না এ জীবনে। কেউ আর আব্বুর মতো নিঃস্বার্থ ভালোবাসে না। সবার ভালোবাসার ভণিতার মাঝে স্বার্থ কাজ করে। সবাই ভালোবাসার অভিনয় করে বিনিময়ে কিছু নিতে চায়। কিন্তু আব্বু, আপনারা তো কিছু নিতে চান না, শুধু দিতে চান। আব্বু আমার খুব আবেগী ছিলেন। আমাকে খুব শাসন করতেন। খুব আদর করতেন। পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা নেই, এমন কোনো সাহিত্য নেই, যা দিয়ে আমার মনের এ ক্ষতকে প্রকাশ করতে পারব। এমন কোনো সান্ত্বনার বাণী নেই, যা শুনিয়ে আমার বুকের মাঝে পাথরচাপা কষ্টগুলোকে কমানো যাবে। আমার আব্বু নেই। আমার বটবৃক্ষ নেই। যে আমার জন্ম থেকে তার শীতল ছায়া দিয়ে বড় করেছে। এখন গ্রীষ্মের দাবদাহে আমার গা পুড়ে ছারখার হবে। কেউ আর বটবৃক্ষের ছায়া নিয়ে আমার পাশে দাঁড়াবে না। কেউ না। আমি সূর্যের তেজে মোমের মতো গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যাব ধীরে ধীরে।
আমার আব্বু একজন ভালো ও নীতি–আদর্শবান ছিলেন। তিনি ছিলেন বললে ভুল হবে, তিনি এখনো আমাদের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে থাকেন, এটা আমার অনুভব, আমার বিশ্বাস। আমার জন্ম ও শিক্ষাজীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত। চলার পথে, কি পারিবারিক জীবন ক্ষেত্রে, কি পেশা/চাকরি জীবন ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হয়েছি। আব্বু আমার, তার মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাকে তাঁর প্রশস্তবুকে আগলে রেখেছিলেন। এখন কোনো বিপদে দিশেহারা হয়ে পড়ি। অভিভাবকহীনতার কষ্টে ভুগি। কারও পরামর্শ চাইলে শুনতে হয়, ‘দেখো, তুমি অনেক বড় হয়েছ , চাকুরী করো, আমাদের চেয়ে ভালো বোঝো, যা ভালো মনে করো, তা–ই করো।’ এখন কেউ বলার নেই, থাম, আমি দেখছি, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো- নিজে ভালো থাকলে, ঠিক থাকলে, সবই ভালো থাকে বা হয়। মাথায় স্নেহের হাত বোলানোর কেউ নেই। আব্বু থাকতে মনে হতো না আমি বড় হয়েছি, মনে হতো এখনো ছোট আছি। এখন মনে হয় বয়স হয়েছে, নিজেরই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আব্বু হারানোর ব্যথা বা আব্বুহীন জীবনের কষ্ট ভয়ানক। যে বাবা হারায়নি, সে এই ব্যথা বুঝবে না। আমার আব্বু অনেক সময় আমাকে বলতেন, তুমি খুব আবেগপ্রবণ, হুজুকে চলো, বাস্তববাদী না, ঠিক সময় ঠিক কাজ করতে পারি না, যার কারণে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। তাই মাঝেমধ্যে বকা শুনতে হতো।
পিতৃহীনতার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে রয়েছে কতশত আর্তনাদের গল্প। একেক জনের একেক কারণ। এই সংগ্রামের পথটা অনেক বেশিই কণ্টকময়। তবুও জীবন থেমে থাকে না। বাবাহীনতার শূন্যতা বুকে চেপেই সন্তানরা লড়ে যায়। কেউ লড়ে বিধবা মায়ের মুখের হাসি ফোটাতে, কেউ গোটা সংসারের দায়িত্ব নিতে, কেউ নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে। গল্পগুলো ভিন্ন হলেও কারণটা এক। এমন হাজারো গল্প রয়েছে যেটা হয়তো লিখে শেষ করা যাবে না। যে কথাগুলো ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টদায়ক। বাবা নামক অমূল্য এই শব্দটি যেন কারও জীবন থেকে বড্ড অসময়ে হারিয়ে না যায়।
আব্বু আমাদের জন্য তাঁর আদর্শ রেখে গেছেন। না, আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কীভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।
আব্বু যে কি পরম বস্তু তা আজ বুঝছি-যখন আমিও আজ একজন “বাবা”। কতদিন আব্বু ডাকা হয়নি আপনাকে- আর হবেনা কোনদিনই? আপনাকে এখনো মাঝেমধ্যে স্বপ্নে দেখি। আমি আর আপনি একসাথে খাচ্ছি, একসাথে হাঁটছি পাশাপাশি। জানেন আব্বু, বুকের গভীরে একটা স্মৃতিসৌধের আয়না আছে যার মুখোমুখি দাঁড়ালেই আপনাকে দেখতে পাই, অনুভবে স্পর্শ করতে পারি আপনার অস্তিত্ব।
আমার আব্বু জনাব আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোঃ আব্দুল ওহাব সাহেব ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক, সমাজ সেবক ও কর্তব্যপরায়ন একচিলতে মানুষ । মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতার পাশা পাশি বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজ করে গেছেন। অপরের দু:খে তিনি দূ:খিত হতেন, হাত বাড়িয়ে দিতেন অনায়াসে। তিনি নিজের সন্তানের চেয়েও অপরের সন্তানকে বেশি ভালবেসেছেন। বিশিস্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও মাদ্রাসার শিক্ষক করায় এলাকার সবাই “মাওলানা সাহেব” বলেই ডাকতো। আপনি ছাড়া আমি একজন অসম্পূর্ণ মানুষ। আপনি থাকলে যা শিখতাম, তা হয়নি আর আমার জীবনে। তবে আব্বু আপনার আদর্শ যেন জীবনে প্রতিফলিত হয় আর আপনার এ আদর্শ নিয়েই আগামী পথগুলো যেন চলতে পারি সে দোয়া করবেন।
আব্বু আপনাকে নিয়ে লিখলে লেখা শেষ হবে না আমার হৃদয়ের হার্ডডিস্কে। ডিলেট করতে পারিনা আপনার হাজারো স্মৃতির কোন ফাইলটা । স্মৃতিপটে রয়ে যাবে আপনার স্মৃতি চিহ্নটা। শুধু মন খারাপ হয়ে যায়- হাত বাড়ালে আপনাকে আর ছোঁয়া যাবে না, পা ছুঁয়ে সালাম করা হবে না, কোনদিন আর আদর করবেন না, খুশী হবেন না আমার সাফল্যে। আব্বু, আজ আপনি ছাড়া আমরা যে কী অসহায়, তা বুঝতে ভুল হয় না একটিবার। আপনি ছিলেন আমাদের প্রাণ আর আমিও ছিলাম আপনার প্রাণ।
‘ও আমার রব! আমার প্রিয় আব্বুর প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে আব্বু আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’ আমিন।
লেখকঃ-
মুহাম্মাদ ইমাদুল হক ফিরদাউছ প্রিন্স
সহকারী রেজিস্ট্রার
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।