ডেস্ক রিপোর্ট : অবশেষে মহাকাশে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযাগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। ‘বঙ্গবন্ধু-১’ এই নামটির মাধ্যমেই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে- একটিই নয়, ভবিষ্যতে দেশের আরো কয়েকটি স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এরপরই সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণের কাজ শুরু হবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশে খুলে দেয়া বিপুল সম্ভাবনার অংশীদার হয়ে উঠছে। এই স্যাটেলাইট তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি এবং সম্প্রচার শিল্পের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।
বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের এই প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ এখনো যেসব দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট ও টেলিকমিউনিকেশন সুবিধার আওতায় আসেনি সেইসব এলাকায় এই সুবিধা সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।
মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থান করে উপগ্রহটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং পর্যবেক্ষণে দেশের সক্ষমতা সম্প্রসারিত করবে। উপগ্রহটি থেকে সার্ক দেশগুলোর পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজাকিস্তান, কিরঘিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিস্তান এবং কাজাকিস্তানের একটি অংশ সুযোগ নিতে পারবে।
বাংলাদেশে অপ্রত্যাশিত কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বর্তমান টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা যদি কখনো ভেঙ্গে পড়ে তখন গোটা দেশব্যাপী এই যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবিচ্ছিন্নভাবে সচল রাখা নিশ্চিত করতে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তৃতীয়তঃ স্যাটেলাইট ট্রান্সপন্ডার বিক্রির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে। বর্তমানে এই অন্যান্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই সেবা পেতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। বিশেষ করে সম্প্রচার শিল্পের জন্য এসব স্যাটেলাইটের সহায়তা নিতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃত্রিম উপগ্রহের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে।বর্তমানে বাংলাদেশের ৩০টির বেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট ভাড়ায় ব্যবহার করছে। এতে বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে এবং আশা করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এর বাণিজ্যিক ব্যবহারে প্রধান ভোক্তা হবে। অপরদিকে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশ থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে। ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়ার জন্য রাখা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেন, নতুন গঠিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানী লিমিটেড (বিএসসিসিএল) ইতোমধ্যেই ট্রান্সপন্ডার ভাড়ার জন্য ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অপর একটি পণ্য উল্লেখ করে বিটিআরসি বলেছে, ৪০টি ট্রান্সপন্ডারে মোট ১ হাজার ৬শ’ এমএইচজেড ফ্রিকুয়েন্সি রয়েছে।
আগে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোর একটা ভয় ছিল যে বঙ্গবন্ধু-১ এর অবস্থান হয়তো তাদের সম্প্রচারে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বাসস’কে বলেন, তারা অন্য স্যাটেলাইটের সহযোগিতায় সহজেই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের সকল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের সম্প্রচারের জন্য এ্যাস্টার-৭ ব্যবহার করছে, যা ৭৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি পূর্বে। শুধু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) তাদের সম্প্রচার এশিয়াস্যাট-৭ থেকে সম্প্রচার কার্যক্রম চালায়, যা ১০৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি পূর্বে।
ক্যাবল টেলিভিশন সার্ভিস প্রোভাইডারদের বিকল্প হিসেবে ডাইরেক্ট-টু-হোম (ডিটিএইচ) তখন স্যাটেলাইটের অন্যতম প্রধান গ্রাহক হবে।
ডিটিএইচ সেবা বিশ্ব ব্যাপী টেলিভিশন বিনোদনের জগতে দ্রুত গতির সেবা দিয়ে থাকে এবং এখন বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে এই সেবা আরও সহজ ও দ্রুততর করবে। স্যাটেলাইট এর ফলে ভিডিও তথা সম্প্রচার সহজ করার পাশাপাশি অনুষ্ঠান কার্যক্রম ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক এবং ডিটিএইচের মাধ্যমে অনায়াসে বিতরণ করতে পারবে।
স্যাটেলাইটে নিজস্ব ভিস্যাট থাকবে যার মাধ্যমে ব্যাংক ও অন্যান্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভয়েস, ডাটা ও ইন্টারনেট সেবা নিতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু-১ এর ফলে ডাইরেক্ট-টু-হো (ডিটিএইচ) ভিডিও সার্ভিস, ই-লার্নিং, টেলি-মেডিসিন, পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি খাতসহ দুর্যোগ উদ্ধারে ভয়েস সার্ভিসের জন্য সেলুলার নেটোয়ার্কের কার্যক্রম এবং এসসিএডিএ, এওএইচও এর ডাটা সার্ভিসের পাশাপাশি বিজনেস-টু-বিজনেস (ভিসেট) পরিচালনায় আরো সহজতর করবে।
বিটিআরসি ২০১৫ সালের নভেম্বরে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট নির্মাণের জন্য ফ্রান্সের থালেস এলিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য স্পেস এক্স এর ফেলকন-৯ লঞ্চার ব্যবহার করা হবে।
নিজস্ব স্যাটেলাইটের দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ৫৭ তম দেশ। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়ার স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারস্পুটনিক’ এর কাছ থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় (স্লট) কক্ষপথ স্লট কিনে।
গাজীপুরে প্রস্তুত প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশন :
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর এটির নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রস্তুত আছে এর প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তেলীপাড়ায় টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে ওই স্টেশন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন লাগবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।এ উৎক্ষেপণ দেখতে হলে আগ্রহীদের উৎক্ষেপণ স্থানের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিতে হবে। সাত মিনিটের কম সময় দেখা যাবে, তার পরপরই উচ্চগতির রকেট চলে যাবে দৃষ্টি সীমার বাইরে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ-১ খুলে নিচের দিকে নামবে, এরপর চালু হবে স্টেজ-২। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ পৃথিবীতে এলেও স্টেজ-২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যাবে।দুটি ধাপে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি হলো ‘লঞ্চ অ্যান্ড আরলি অরবিট ফেইজ’ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে ‘স্যাটেলাইট ইন অরবিট’। প্রথম ধাপে ১০ দিন এবং পরের ধাপে ২০ দিন লাগবে। উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে যাবে এই স্যাটেলাইট। ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যাবে। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে।এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্পট) স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশের স্যাটেলাইটটিতে লেখা থাকবে বিবি এবং থাকবে একটি সরকারি লোগো। (সূত্র : কালের কণ্ঠ ও এনটিভি)