Latest News
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৬ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Home / জাতীয় / জীবনানন্দের খোঁজে: কলকাতার দূরে; খড়্গপুরে

জীবনানন্দের খোঁজে: কলকাতার দূরে; খড়্গপুরে

আমীন আল রশীদ :

কলকাতা শহরলাগোয়া হুগলি নদীর উপরে হাওড়া ব্রিজ পার হলেই ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কমপ্লেক্স ও স্টেশন। টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। খানিক বাদে যাত্রীরা পাশে আরেকটি কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। আগের কাউন্টার থেকে জানানো হয়, ১০টির বেশি টিকিট দেয়া হবে না। সেখানে নোটিস—কাউন্টার ক্লোজড। এভাবে তিন দফায় লাইন পরিবর্তনের পরও খড়্গপুরের টিকিট না পাওয়ার দৃশ্য দেখে একজন দালাল এসে জানতে চান, ‘রিজার্ভেশন’ লাগবে কিনা। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই তিনি নাম ও বয়স জেনে দৌড়ে গিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেসের একটি টিকিট নিয়ে আসেন। হাওড়া স্টেশন থেকে খড়্গপুরের যা ভাড়া, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে একটি টিকিট হাতে পাই। জীবনানন্দকে খুঁজতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে বাড়তি দামে ট্রেনের টিকিট কাটার এ বিষয়টিও একটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল।

৫৫ বছরের জীবনে জীবনানন্দ দাশ চাকরি করেছেন ২০ বছরের কিছু বেশি সময়। এর মধ্যে ১৯৩৫-৪৬ জন্মস্থান বরিশাল শহরে অবস্থিত ব্রজমোহন কলেজ ও জীবনের শেষ সোয়া এক বছর হাওড়া গার্লস কলেজ ছাড়া কোথাও খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। কোথাও স্থায়ী হননি। কখনো নিজে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, কখনো বরখাস্ত হয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় কলকাতা শহর থেকে বেশ দূরের এই খড়্গপুর কলেজেও তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। পথের দূরত্বহেতু কলেজ ক্যাম্পাসে বসবাস, স্ত্রীর অসুস্থতা, কলেজের আর্থিক সংকট—সব মিলিয়ে খড়্গপুরকে বিদায় বলতে হয় চাকরিতে যোগদানের অর্ধবছর না হতেই। শেষ দিকের পাওনাটুকুও জোটেনি। তবে এই সামান্য সময়ে জীবনানন্দ খড়্গপুরে কেমন ছিলেন, কী করেছেন, মৃত্যুর পর তাকে কি এই শহর মনে রেখেছে, কোথাও কি তার স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে—এসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারির শেষ দিকের এক মধ্য দুপুরে রাঁচি এক্সপ্রেসে চেপে খড়্গপুরের পথে যাত্রা।

হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ার আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই সেই কাঙ্ক্ষিত স্টেশন। বিশাল প্লাটফর্ম, রেলের কর্মযজ্ঞ। এটিই নাকি বিশ্বের দীর্ঘতম (১০৭২ দশমিক ৫ মিটার) প্লাটফর্ম। এখানের একটি সাইনবোর্ডেও সে কথা লেখা। স্টেশন থেকে বের হতেই স্বাগত জানান এই শহরের জীবনানন্দপ্রেমিক কামরুজ্জামান। তার সাথে মোটরসাইকেলে চড়ে শহরের সরু রাস্তা ধরে প্রথম গন্তব্য সিলভার জুবিলি হাইস্কুল। কেননা এ স্কুলের ক্যাম্পাসেই যাত্রা করেছিল খড়্গপুর কলেজ এবং জীবনানন্দ দাশ এখানেই পড়াতেন, এই ক্যাম্পাসেই থাকতেন।

এলেন জীবনানন্দ

১৯৪৮ সালের দাঙ্গার শিকার হয় তত্কালীন পূর্ব বাংলার মানিকগঞ্জ কলেজ (বর্তমান নাম সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ)। এ কলেজের হিন্দু অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মীরা তখন পশ্চিম বাংলায় চলে যান। ছিন্নমূল এ মানুষেরা তখন খড়্গপুরে একটি কলেজ স্থাপনের চেষ্টা করেন, যার নেতৃত্ব দেন মানিকগঞ্জ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ইতিহাসবিদ হিমাংশুভূষণ সরকার। তারই প্রচেষ্টায় বছর দেড়েক পর খড়্গপুরের পুরাতন বাজারে কৌশল্যা মোড়ের কাছে সিলভার জুবিলি ইনস্টিটিউটে ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট খড়্গপুর কলেজের যাত্রা হয়।

সকাল পৌনে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বাণিজ্য বিভাগ ও সন্ধ্যা পৌনে ৭টা থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত কলা বিভাগের ক্লাস হতো। তখন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন মাত্র একজন—সরোজকুমার ভট্টাচার্য। একজনের ওপর চাপ পড়ছিল বলে নতুন একজন অধ্যাপকের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। জীবনানন্দ তখন কর্মহীন। আবেদন করলেন এবং অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তখন জীবনানন্দ সাহিত্যমহলে বেশ পরিচিত নাম। ফলে প্রার্থীদের মধ্যে তিনিই যোগ্যতম বিবেচিত হন। কলেজ প্রতিষ্ঠার এক বছর পরই ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি এখানে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। যদিও ছিলেন মাত্র ৫ মাস ১২ দিন, পরের বছর ১৯৫১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

গবেষক কামরুজ্জামান জানান, কলেজে যোগদানের আগে জীবনানন্দ সচক্ষে এখানের পরিবেশ দেখা এবং সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হতে আসেন। এ সময় অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে জীবনানন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। শুধু তা-ই নয়, কলকাতায় ফেরার পথে কবিকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেন খোদ অধ্যক্ষ। স্টেশন থেকে কলেজ পর্যন্ত যেতে রেলের কর্মশালা, চারপাশে লাল মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রুক্ষ সবুজ বনানী দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে গিয়ে কবি অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণকে কলেজে যোগ দেয়ার বিষয়ে তার সম্মতির কথা জানিয়ে ৪ আগস্ট একটি চিঠি লেখেন। এরপর ২৫ আগস্ট আরেকটি চিঠিতে কলেজে তার থাকার জন্য একটি সিঙ্গেল সিটের রুমের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। তিনি ১ সেপ্টেম্বর কাজে যোগ দিতে চান বলেও জানান। খড়্গপুর কলেজ দেখতে গেলেও ইংরেজির অধ্যাপক সহকর্মী সরোজকুমারের সঙ্গে দেখা না হওয়ার জন্য তিনি দুঃখপ্রকাশও করেন এবং অনুরোধ করেন, মি. ভট্টাচার্য যেন তাকে জানান যে তাকে যেন জানানো হয়, দ্বিতীয় বর্ষের সিলেবাস কী।

অবশেষে ২ সেপ্টেম্বর কলেজে যোগ দেন জীবনানন্দ। সিলভার জুবিলি ইনস্টিটিউটের পাশের ছাত্রাবাসের একটি ঘরে তার জন্য থাকার ব্যবস্থা হয়। অন্য কোনো শিক্ষক এ ছাত্রাবাসে থাকতেন না। এর দেখাশোনার ভার ছিল বাংলা ও সংস্কৃতর অধ্যাপক পুলিনবিহারী পালের ওপর। ফলে এখানে বসবাসের সুবাদে মি. পালের সঙ্গে জীবনানন্দের একটা সখ্যও গড়ে ওঠে।

সিলভার জুবিলির মঞ্চ  ম্যাগাজিন

সিলভার জুবিলি স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শিতিকণ্ঠ দে জীবনানন্দ অন্তঃপ্রাণ মানুষ। কথাবার্তায় বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, এই কবিকে তিনি কতটা পছন্দ করেন। চেয়ার থেকে উঠে স্কুল প্রাঙ্গণে মাঠের পূর্ব দিকে কংক্রিটের মঞ্চটি দেখিয়ে বললেন, জীবনানন্দের নামেই এর নামকরণ করা হবে। এ স্কুল ভবনে খড়্গপুর কলেজে জীবনানন্দের মতো একজন মানুষ অধ্যাপনা করেছেন, বিষয়টি তাঁদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের ও গর্বের বলে মনে করেন মি. দে। কবির জন্ম-মৃত্যু দিবসও বেশ মর্যাদার সঙ্গে এ স্কুলে পালন করা হয় বলেও জানান তিনি। স্কুলের একটি আলমারিতে অভিযান চালিয়ে উইপোকায় খাওয়া একটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা সম্ভব হলো, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালের মার্চে। ‘কণিশ’ নামে ওই ম্যাগাজিনটিকে বলা হচ্ছে প্লাটিনাম জুবিলি সংখ্যা। এর সম্পাদনা করেন সুষমা সাহা ও তাপস কুমার বিষুই। এ ম্যাগাজিনে জীবনানন্দকে নিয়েও দুটি প্রবন্ধ রয়েছে। একটি লিখেছেন স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্যামল দত্ত, অন্যটি বাংলা বিভাগের সহশিক্ষক এবং এ ম্যাগাজিনের অন্যতম সম্পাদক তাপস কুমার বিষুই।

‘জীবনানন্দ দাশ’ শিরোনামের প্রবন্ধে মি. দত্ত মূলত জীবনানন্দ দাশের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেছেন। তার জন্ম, পরিবার, পারিবারিক আবহ, বেড়ে ওঠা, কর্মজীবন, এমনকি বিয়ে। সংক্ষেপে এই খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনার বিবরণও রয়েছে। তিনি লিখেছেন, তখন খড়্গপুর কলেজটি সিলভার জুবিলি হাইস্কুলের টালিছাওয়া বাড়িতে সকালে কলা বিভাগ ও সন্ধ্যায় কমার্স বিভাগে ক্লাস হতো। কলেজের অফিস ঘরটি ওই স্কুলের মাঠের দক্ষিণে রাস্তার ধারে দোতলা বরমসী ভবনে ছিল। জীবনানন্দ অফিসের দোতলায় একটি ঘরে থাকতেন। ‘জীবনানন্দ যে পরিচয় প্রকাশ করেননি’ শিরোনামের প্রবন্ধে তাপস কুমার বিষুই কবি পরিচয়ের বাইরেও জীবনানন্দের যে গদ্যশিল্পী হিসেবে আরেকটি বড় পরিচয় রয়েছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করেন।

অবলম্বনহীনঅসহায়অবাস্তব

জীবনানন্দের জীবনযাপন বরাবরই সাদাসিধে, আটপৌড়ে। বিলাসিতা নেই। থাকার ঘরটা গোছানো রাখতে পছন্দ করতেন। কিন্তু সেখানে আসবাব বেশি কিছু থাকত না। কলকাতায় ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতেও তার নিজের ঘরটা ছিল ছিমছাম। খড়্গপুর কলেজেও যে রুমে তার থাকার ব্যবস্থা হয়, সেটিও এ রকম অত্যন্ত সাদাসিধে। ছোট একটি খাট, বিছানা, তোরঙ্গ, কিছু বইপত্র, কলম ও কালির দোয়াত। ক্লাসের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে এই রুমের ভেতরেই থাকতেন। দরজা বন্ধ করে পড়তেন, লিখতেন। পুলিনবিহারী ছাড়া সাধারণত কেউ এসে দরজার কড়া নাড়তেন না। যদিও বা অন্য কেউ এসেছেন, অনেক সময় হয়তো আত্মমগ্ন কবি তা টের পেতেন না। এখানে থাকায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা বা কিছু লাগবে কিনা, পুলিনবিহারীর এসব প্রশ্নের উত্তরও দিতেন অতি সংক্ষেপে, হ্যাঁ অথবা না। পুলিনবিহারী নিজেও লিখতেন। মূলত প্রবন্ধ, নিবন্ধ। জীবনানন্দ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, ‘জীবনানন্দকে প্রতি মুহূর্তে অবলম্বনহীন, অসহায় ও অবাস্তব এক মানুষ বলে মনে হতো।’

৬টি চিঠি৬টি কবিতা

এ কলেজে অধ্যাপনার পাঁচ মাস সময়ে জীবনানন্দ কী কী লিখেছেন, তার বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। হয়তো কিছু লেখার খসড়া করেছেন, অথবা কোনো গল্প-উপন্যাসের প্লটও তৈরি করেছেন কিংবা কোনো কালজয়ী কবিতাই হয়তো এই হোস্টেলে বসে লিখেছেন; কিন্তু কী লিখেছেন তা এখনো জানা যায়নি। তবে কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকারকে ইংরেজিতে পাঁচটি ও সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে বাংলায় একটিসহ মোট ছয়টি চিঠি লিখেছিলেন, যা পরবর্তীকালে উদ্ধার করেন গবেষক কামরুজ্জামান (জীবনানন্দ এক ঝলক হাসির মতন এসেছিলেন খড়্গপুর কলেজে, আরম্ভ, ২০১৭)। যদিও চিঠিগুলো এখনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রভাতকুমার দাস তার ‘পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ’ গ্রন্থে যে ১৩১টি চিঠি উল্লেখ করেছেন, সেখানেও খড়্গপুরে থাকাকালীন এই চিঠিগুলো গ্রন্থভুক্ত হয়নি।

খড়্গপুরে বসবাসের সময়ে তার ছয়টি কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বলে পরবর্তীকালে জানা যায়। জীবনানন্দের অনেকগুলো মিরাকল বা ব্যাখ্যাতীত ঘটনার মধ্যে এটিও একটি যে খড়্গপুরে বসবাসের সময়ে তিনি সহকর্মীদের ছয়টি চিঠি লিখেছেন, আবার এই সময়েই তার ছয়টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাগুলোর হদিস দিচ্ছেন কামরুজ্জামান। এগুলো হচ্ছে ‘পৃথিবী আজ ’(সত্যযুগ, শারদীয়া সংখ্যা ১৩৫৭), ‘রাত্রি মন মানবপৃথিবী’ (সত্যযুগ, শারদীয়া সংখ্যা ১৩৫৭), ‘ক্রান্তিবলয়’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, শারদীয়া সংখ্যা ১৩৫৭), ‘আজ’ (নির্ণয়, শারদীয়া সংখ্যা ১৩৫৭), ‘দেশ কাল সন্ততি’ (যুগান্তর, শারদীয়া সংখ্যা ১৩৫৭) ও ‘লোকেন বোসের জর্নাল’ (পূর্বাশা, কার্তিক ১৩৫৭)। তবে এ কবিতাগুলো কোনো সময়ে লেখা, তা পরিষ্কার নয়। কারণ জীবনানন্দ অনেক সময়ই লেখার নিচে তারিখ উল্লেখ করতেন না। আবার একই কবিতার একাধিক পাঠ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিনি প্রচুর খসড়া করতেন।

বিদায় খড়্গপুর

কলকাতা শহর থেকে বেশ দূরের এই কলেজে যোগদানের পর জীবনানন্দ ভাবছিলেন, এখানেই থেকে যাবেন। এ সময়ে খড়্গপুরের হিতকারিণী স্কুলে স্ত্রী লাবণ্য দাশের চাকরির সুযোগও হয়েছিল। ফলে এখানে থেকে যাওয়ার বিষয়ে সবকিছু অনুকূলেই ছিল। এ কারণে হিতকারিণী স্কুলের পাশে দত্তবাবুর একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়ার বিষয়ে কথা পাকাপাকিও করে ফেলেছিলেন। সব ঠিকঠাক করে ডিসেম্বরে কলকাতায় গিয়েছিলেন স্ত্রীকে আনতে। কিন্তু লাবণ্য তখন ভয়াবহ অ্যাজমায় আক্রান্ত। তার ওপর প্রচণ্ড শীত। স্ত্রীর শুশ্রূষায় চলে গেল কয়েক দিন। পরিস্থিতির পরিবর্তনে তিনি কলকাতা থেকে অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণকে চিঠি লিখে জানান, তিনি যেন ফ্ল্যাটের মালিককে অনুরোধ করেন, যাতে তিনি অন্য কাউকে এটি ভাড়া দিয়ে দেন। তবে শিগগিরই তিনি কলেজে যোগ দেবেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন।

১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের ঠিকানায় বসে লেখা ওই চিঠিতে জীবনানন্দ উল্লেখ করেছেন, ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন, যেন এই শীতে তার স্ত্রীকে কোথাও স্থানান্তর করা না হয়। তাতে হাঁপানি আরো বেড়ে যেতে পারে। ফলে আগামী বসন্ত অথবা গ্রীষ্মের আগে পরিবার নিয়ে খড়্গপুরে আসার সম্ভাবনাও তিনি বাতিল করে দেন। প্রসঙ্গত, শেষ পর্যন্ত এই হাঁপানিতেই মারা যান লাবণ্য দাশ।

একদিকে স্ত্রীর অসুস্থতা, অন্যদিকে তার নিজেরও মাঝেমধ্যেই জ্বর, অনিদ্রা ও স্নায়ুবিকার। ফলে ছুটিতে কলকাতায় এলে নির্দিষ্ট সময়ে কলেজে ফিরতে পারেন না। সবসময়ই দেরি হয়ে যায় এবং দুঃখপ্রকাশ করে অধ্যক্ষকে চিঠি লেখেন। ফেব্রুয়ারিতেও কলেজে থাকাকালীন কয়েকদিন জ্বরে ভোগেন। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে কোনোক্রমে ক্লাস নিয়ে কলকাতায় চলে যান। তখন স্ত্রী লাবণ্যর শরীরও খারাপ, শয্যাশায়ী। ডাক্তারি পরীক্ষায় এ সময় লাবণ্যর অ্যানজাইনা ধরা পড়ে। ফলে অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে খড়্গপুরে যাওয়া সম্ভব হলো না। ডাক্তার জানালেন, স্ত্রীর সুস্থ হতে অন্তত মাস তিনেক সময় লাগবে। ফলে জীবনানন্দ ছুটির আবেদন করলেন। প্রথমত কলেজটি নতুন, তার ওপর ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক তিনিসহ মাত্র দুজন। ফলে ঘন ঘন ক্লাস কামাই এবং এ রকম ছুটির আবেদনে হয়তো কলেজ কর্তৃপক্ষ তার ওপর বিরক্তও হয়ে ওঠে। যদিও সে বিরক্তি কখনই প্রকাশ করেননি অধ্যক্ষ বা তার বিভাগের সহকর্মী সরোজকুমার। অবশ্য ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ কলেজের অধ্যক্ষকে তিনি সর্বশেষ যে চিঠিটি লেখেন, সেখানে তিনি তার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন এবং লেখেন, যদি ছুটির আবেদন গৃহীত না হয়, তাহলে তার কাজে ইস্তফা দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। মূলত ১৯৫১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি সর্বশেষ ক্লাস নেন। ফলে এই তারিখটিকেই তার শেষ কর্মদিবস হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

ওই বছরের ২ এপ্রিল কলেজ পরিচালনা সমিতির সভা হয়, যেখান মূল আলোচ্য বিষয় ছিল জীবনানন্দের দীর্ঘ অনুপস্থিতি। সভায় ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগদানের পর থেকে পরের বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি যেসব ছুটি নিয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা হয়। এই ছুটির ফলে ক্লাসে ব্যাঘাত, কলেজের অর্থনৈতিক সংকট ও শর্তসাপেক্ষে ইস্তফার বিষয়ে কবির চিঠিটিও বিবেচনায় নেয়া হয়। সব মিলিয়ে সভায় সর্বসম্মতভাবে জীবনানন্দের দীর্ঘ ছুটির আবেদনটি অগ্রাহ্য হয় এবং ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় পদটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর জীবনানন্দকে জানিয়ে দেয়া হয়—ণড়ঁৎ ংবৎারপব রং হড় ষড়হমবৎ ত্বয়ঁরত্বফ.

খড়্গপুর কলেজের এ চাকরিটা চলে যাওয়ার দুদিন আগেই তিনি সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে তার আর্থিক দুরবস্থা ও মানসিক বিপর্যয়ের বিস্তারিত তুলে ধরেন। ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে তিনি জানান, খড়্গপুর কলেজ থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মাত্র ৩০ টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে যে কাজ করলেন, সেই টাকা এখনো পাননি। ফলে বিগত দিনের পাওনাটা না পেলে এই দুর্দিনে টিকে থাকা মুশকিল। এপ্রিলের কোনো এক সময়ে তিনি শেষবারের মতো খড়্গপুরে আসেন এবং রুমের ভেতরে থাকা বিছানা, বইপত্র নিয়ে নিঃশব্দে চলে যান।

আবক্ষ মূর্তিলাইব্রেরি

সিলভার জুবিলি স্কুলে খড়্গপুর কলেজের যাত্রা হলেও পরে কলেজের জন্য এ স্কুল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ৪০ বিঘা জমি দান করেন পঞ্চবেড়িয়া এলাকার নাসির আলী খানের স্ত্রী সালেহা খাতুন। ১৯৫১ সালের ২ জুলাই সেখানে কলেজের নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। জায়গাটি খড়্গপুর রেলস্টেশন থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ওড়িশা-ট্রাঙ্ক রোডের পাশে। মূল সড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে সুবিধা হয়। বড় গেট পেরিয়ে কলেজে ঢোকার পরই চোখে পড়বে বিশাল পুকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ প্রখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য। সবুজ গাছপালাঘেরা পুরো ক্যাম্পাসে এক ধরনের আশ্রমের আবহ। ১৯৯৯ সালে জীবনানন্দের জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি এই কলেজ ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশে জীবনানন্দের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে। আর লাইব্রেরির নামও দেয়া হয় জীবনানন্দ গ্রন্থাগার। সেই সঙ্গে কলেজসংলগ্ন শিক্ষকদের কলোনির নামও এখন জীবনানন্দ কলোনি।

সহকর্মীর চোখে

১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি খড়্গপুর কলেজ জীবনানন্দ দাশের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জীবনানন্দের সময়ের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকার ও তার আরেক সহকর্মী সরোজকুমার ভট্টাচার্যকে। কিন্তু তাদের কেউই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। স্বশরীরে উপস্থিত না হলেও তারা লিখিত আকারে দুটি বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন। যেখানে হিমাংশুভূষণ সরকার উল্লেখ করেন, নতুন এ কলেজ নানা রকম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। যে কারণে শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারীকে নিয়মিত বেতন দেয়া সম্ভব হয়নি। জীবনানন্দ দাশ রাতের ক্লাসগুলো নিতেন। কিন্তু চোখের অবস্থা ভালো না হওয়ায় রাতে লিখতে ও পড়তে অসুবিধা হতো। তাছাড়া স্ত্রী যেহেতু কলকাতায় থাকতেন, তাই তাকে প্রতি সপ্তাহে সেখানে যেতে হতো। একদিকে কলেজের আর্থিক টানাপড়েন, অন্যদিকে কলকাতা-খড়্গপুর ছোটাছুটির কারণে জীবনানন্দ এই কলেজে কাজের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

কলেজের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত শিক্ষক সরোজকুমার ভট্টাচার্যও একটি লিখিত বক্তব্য পাঠান, যেখানে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, তার নিজের জীবনের সংকটসহ নানা বিষয় তিনি উল্লেখ করেছেন। এমনকি জীবনানন্দের কবিতার শক্তি ও সৌন্দর্য নিয়েও তিনি তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। ইংরেজিতে লেখা ওই চিঠি বা বক্তব্যের একটি জায়গায় মি. ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘জীবনানন্দ ক্লাসরুম বা পরীক্ষার হলের জন্য নন, তার স্থান মানুষের হূদয়ে।’

(লেখক : সাংবাদিক ও কবি জীবনানন্দ দাশ গবেষক)